সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ধাপগুলোকে ওর সেই প্রথম দিনের মতন উঁচু উঁচু, বেয়াড়া বেয়াড়া ঠেকল। কিছুটা বিপজ্জনকও। ও খুব সন্তর্পণে, পাশের দেওয়ালে হাত রেখে রেখে নামতে লাগল সামনে নীচের দিকে তাকিয়ে। কপালের কিছুটা রক্ত ওর চশমার কাচে পড়ে দৃষ্টিটা ঘোলাটে করে দিল। কিন্তু শংকরলাল ওর চশমা পরিষ্কার করল না।
আমার শুধুই মনে হতে লাগল, আমি চশমা পরিষ্কার করব কেন? আমি তো খুব বেশি বেশি দেখছি এখন। ভূত-ভবিষ্যৎ বর্তমান সবই এখন একযোগে আমার নাগালে। আমি যেদিকে খুশি যেতে পারি। রানি যখন আমার বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করত আমি বলতাম, দেখো আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এই যে বইটা লিখছি এটাই আমার ভবিষ্যৎ। প্রচন্ড উম্মার সঙ্গে রানি বলত, তোমার ওই ছাতার বই কবে লেখা শেষ হবে? আমি বলতাম, তোমার মৃত্যুতে। কারণ, এই বইয়ের নাম ‘শেষ বাইজি’। তুমিই সেই শেষ বাইজি, তোমার সঙ্গে এই পাড়ার সব ইতিহাসের শেষ। রানি তখন প্রশ্ন তুলত, কে বলেছে তোমায় আমিই শেষ বাইজি? কত এসেছে এখানে আর কত আসবে। আমি নাচ-গান তো এখন আর করিই না, তাতে এই মহল্লার কিছু ক্ষতি হয়েছে? আমি বলতাম, তুমি না থাকলে আমার কাছে এই মহল্লাও আর থাকবে না। তখন একটাই আবদার থাকত ওর, তাহলে আমাকে খুন করে খেলা শেষ করে দাও।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে শংকরলালের মনে পড়ল আরও একদিনের ঘটনা। মদ ঢেলে দিতে দিতে হঠাৎ-ই রানি বলল, ২১২ নম্বরের আশিকী বাই যা স্বপ্নে দেখে তাই ঘটে। ও সেদিন আমায় বলল, তোর বাবু কি বই লেখে? আমি বললাম হ্যাঁ। একটা বই লিখছে এখন। তখন ও বলল, ওই বই লেখা হয়ে গেলে বাবু আর আসবে না তোর কাছে। শুনে ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল আমার। কিন্তু তারপরেই আশিকী বলল, কিন্তু তোর দুঃখ নেই রানি। তোকে খুদা উঠিয়ে নেবে। আর তখন কী আনন্দই না হল আমার। আমার তো আর বাঁচতে ইচ্ছেই হয় না। সবটাই কীরকম নাটক-নাটক লাগে। কোনো কিছুকেই আমায় আর সত্যি মনে হয় না।
খুব রাগ হয়েছিল শংকরের এই সব কথায়। খুব ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, কেন এই সব পাগল মেয়েছেলেদের কথা শুনতে যাও তুমি? ফের এই সব কথা তুলবে তো আমি এখানে আসা বন্ধ করে দেব। এই শেষের কথাটা উচ্চারণ করেই মনের ভেতর কোথায় যেন হোঁচট খেল শংকর! ওর মনে পড়ে গেল অজয়কে। অজয়কে মনে পড়ে গিয়েছিল রানিরও, কারণ ও জিজ্ঞেস করল, অজয়বাবুর সঙ্গে দেখা হয় তোমার? এর চেয়ে দুটো গালি দিলেও ভালো করত রানি। ওই নামটাতেই কীরকম দগ্ধাচ্ছে শংকরের ভেতরটা। আজই সকালে ওর পান্ডুলিপি জমা দিয়েছে ও প্রকাশকের ঘরে। যারা ওই দু-হাজার পাতার দীর্ঘ পান্ডুলিপি পড়েছে তারা সবাই একমত যে ওরকম গম্ভীর, বাস্তব, দার্শনিকতাসম্পন্ন বই বাংলায় লেখা হয়নি কোনোদিন। কেউ কেউ বলল, এ বই খুব বড়ো পুরস্কার পাবে। কেউ বলল, এই বই বাংলা সাহিত্যে একটা রত্ন হয়ে থাকবে। মিতবাক প্রকাশক মহাশয় শুধু বললেন, এই বই কাকে উৎসর্গ করবেন শংকরবাবু? শংকর বহুক্ষণ নীরব থেকেছিল তখন। তারপর খুব আস্তে আস্তে বলল, অজয় চৌধুরীকে। প্রকাশক কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে বললেন, তিনি কে? এ নাম তো কখনো শুনেছি বলে মনে হয় না আপনার কাছে। শংকর ফের খুব ধীর কণ্ঠে, প্রায় অন্যমনস্কভাবে বলল, সে আমার বন্ধু।
আমি ফের বউবাজারের সেই গলিটায় এসে দাঁড়িয়েছি। আমার খুব তৃপ্তি হয়েছে আজ দুটো কাজ প্রায় নিখুতভাবে সম্পন্ন হওয়ায়। শেষ বাইজি’ বইটা যেভাবে যেখানে শেষ করতে চেয়েছিলাম তা পেরেছি। নায়িকার মৃত্যু দিয়ে একটা গোটা সমাজের ইতিহাসের ইতি টেনেছি। সেই নায়িকাকেও প্রায় বইয়ে বর্ণিত ধারায় খুনও করেছি। আমি ছাড়া কারও পক্ষে এখন বলা মুশকিল ওই হত্যাটা আগে, না ওই বর্ণনাটা। আমি চেয়েছিলাম ঘটনাকে কল্পনার কাছাকাছি টেনে আনতে। কিন্তু রচনাকালে হত্যার দিনক্ষণ ও কারণের কোনো হদিশ পাইনি আমি, আমার গোটা বইয়ে গোঁজামিল শুধু ওইটুকুই। তা আমার স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। আমার জীবনে এই রানি ও তার এই সমাজকে যে তুলে এনেছিল সেই আমার প্রিয় বন্ধু অজয়ই ফের, প্রায় দৈবযোগে, ঘটনাটিকে সত্য করে তুলতে সাহায্য করল। কীভাবে ধন্যবাদ জানাব ওকে আমি?
টলতে টলতে শংকরলাল এবার গলির রাস্তা ধরে এগোতে থাকল ট্রাম রাস্তার দিকে। ওর ক্ষেপ নেই রাস্তার লোক ওকে দেখে কী ভাবছে, কী করছে। রাস্তার পাশে থাকা এক ঠেলাওয়ালা বলে উঠল, ইয়ে বাবু কাঁহাসে হোলি খেলকে আঁয়ে? ঝুল বারান্দায় দাঁড়ানো এক আগ্রাউলি বউ মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে উঠল, হে রাম! ইনকো কোই ছোরি মারা হোগা! এক বাঙালি প্রাতভ্রমণকারী কিছুটা প্রাকুটি হেনে বললেন, যত্তো সব রাবিশ!
শংকর শুধু আপন মনে স্মরণ করছিল অজয়কে। এ পাড়ায় প্রথম দিন ওকে সঙ্গে করে আনতে আনতে বলেছিল, যত যাই করো বাপু এসব মাগির সঙ্গে পিরিত কোরো না। আর যতই সোহাগ জাগুক প্রোটেকশান না নিয়ে কাজকর্ম কোরো না। রোগের ডিপো একেকটা সব। এইটা শুধু মনে রাখবে ডিয়ার ফ্রেণ্ড। এসব কথা বলছি কারণ পৃথিবীর সকলের চেয়ে আমি তোমায় বেশি ভালোবাসি। এ ভালোবাসা কোথাও পাবে না গুরু!
পৃথিবীর সব কিছুর চেয়েও হয়তো শংকরকে বেশি ভালোবাসত অজয়। লেখাপড়া বা অন্য কোনো ক্ষেত্রেই কোনো কৃতিত্ব অর্জন করেনি অজয়। কিন্তু শংকরের উত্তরোত্তর খ্যাতি ও শ্রীবৃদ্ধিতে নিজের পূর্ণতা দেখতে পেত ও শংকরের জীবনের প্রথম বই বেরুনোর পর নিজের পয়সায় মদের পার্টি বসিয়েছিল। বিধ্বস্ত ধনী পরিবারের সন্তান অজয় টাকা আয়ের চেয়ে বেশি ভালো চিনত টাকা ব্যয়ের পথটা। নিজের পয়সায় শংকরের দশ কপি বই কিনে একে-তাকে বিতরণ করেছিল। আর সকলকেই দিয়েছিল একই পরামর্শ, পড়ো আর মানুষ। হও। বলো, কেউ পারে এমন লিখতে আমাদের শংকর ছাড়া? খুব বেশি লোক যখন ওর এই উচ্ছাসের ভাগিদার হয়নি ও হতাশার সুরে বলেছিল, গুরু, তুমি আজকের লেখক নও। বহু এগিয়ে আজ এসব মালের থেকে। সঠিক পাঠক পেতে বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে তোমাকে।