বশির পিছন ঘুরে শংকরলালের পা জাপটে ধরে কেঁদে উঠল, ইয়ে মত বোলিয়ে, ম্যায় গরিব হু, মগর হরামখোর তো নহি হুঁ। মত বলিয়ে অ্যাইসা বাবু! মর যাউঙ্গা। শংকরলালের পায়ের রক্ত এবার উঠে এল ওর হাতে। ও সরবে কাঁদতে কাঁদতে সেই রক্ত নিজের মুখে মাখতে লাগল। ওর ওই কান্না দেখে বারান্দার সব মেয়েরাও এবার একযোগে তারস্বরে কাঁদতে লাগল।
শংকরলালের আবছা আবছা মনে পড়তে লাগল রানির সেই কান্না যেদিন অজয় ওর গায়ে হাত তোলে। অজয়ই এনেছিল শংকরকে রানির কাছে প্রথম। শংকরের পা টলছিল, অজয়ের হাত ধরে কোনো মতে চৌকাঠ পেরিয়ে, পর্দা সরিয়ে ফরাশে এসে ধপাস করে শুয়ে পড়ল। রাত বেশ গভীর শরীরের কোনো অঙ্গেরই এতটুকু জোর নেই। মনেও কোনো পিপাসা তেমনই নেই, শুধু ভয়। অজয় বলল, আমার বন্ধু তোমার সঙ্গে থাকবে আজ। রানি মুখ বেঁকিয়ে বলল। বলতে লজ্জা হল না তোমার? এই বললে সেদিন শাদি করবে, আর আজ একটা লোককে এনে বলছ, শোও এর সঙ্গে। তুমি কি মানুষ?
এই প্রচন্ড মত্ত অবস্থাতেও শংকর বুঝেছিল অজয় একটা ভয়ঙ্কর কান্ড করতে চলেছে। মেয়েটা ওকে ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায়। আজ ওর প্রস্তাবে সে অপমানিত হয়েছে। কিন্তু অজয় ছাড়ার পাত্রই নয়। সে বলল, এ আমার প্রাণের বন্ধু, জিগরি দোস্ত। ওকে খুশি করলে আমি খুশি হব। রানি বলল, কেন, লতা তো আছে। গর্জে উঠল অজয় শাট আপ! আমার বন্ধু আমার প্রেমিকার সঙ্গে শোবে। যদি ‘না’ বল তো আজ শেষ ঢুকলাম এখানে। ফরাশে লটকে পড়ে থাকা শংকরলাল জড়ানো গলায় প্রতিবাদ তুলল, না, জয় না। আমি এর সঙ্গে থাকব। অন্য কাউকে ডাকো। রানি বলল, শুনলে? তোমার বন্ধু কী বলল? ওরও বিবেচনা আছে, যা তোমার নেই। আর তখনই, ঠিক তখনই অজয়ের ডান হাতের থাপ্পড় গিয়ে পড়ল রানির বাঁ-গালে। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝে উঠতে বা বিশ্বাস করতে পারেনি রানি। তারপর একটু একটু করে ওর চোখ দুটো বড়ো হতে লাগল, চোখের কোল বেয়ে জল নামতে থাকল গালে। কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দও উচ্চারিত হল না। চড় খাওয়া গালে বাঁ-হাতের তালুটা ঠেকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকল রানি। যে কান্নার আওয়াজ রাতের আকাশ ফুঁড়ে বেরিয়ে যেতে পারে। অজয় বুঝে উঠতে পারল না কী করবে সে। নিজের হাতের তালুতে ঘুষি মারতে মারতে দুই লাফে ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। তার অক্ষম, মাতাল শরীরটাকে টেনে তুলে শংকরও বেরুতে গেল। কিন্তু চৌকাঠের মুখে হাত দিয়ে দোর আগলে দাঁড়িয়ে গেল রানি। নীচু গলায় বলল, বাবু, ঠেরিয়ে। আপ রহেঙ্গে ইহা ইস রাত।
কখন কোথায় আলো নিভল শংকর জানতে পারেনি। ওকে চিৎ করে কীভাবে ফরাশে শোয়ানো হয়েছিল তাও জানতে পারেনি সে। দেহের কোথাও কোনো উত্তেজনা নেই, শিহরন নেই, প্রয়াস নেই। ও ওইভাবে নিঃসাড় ঘুমিয়েছিল বহুক্ষণ। শেষরাতে ঘুমের প্রবল আস্তরণটা ঈষৎ সরে যেতে ও দেখল অন্ধকার ঘরে ওর অনাবৃত দেহের মধ্যবর্তী অঞ্চলে উপবিষ্ট আছে রানি। রানির চোখ বন্ধ, ঠোঁটে সামান্য হাসি, রানির দেহও অনাবৃত এবং ওর শরীর ছন্দে ছন্দে দুলছে শংকরের শরীরের ওপর। সমস্ত ঘটনাটিকে স্বপ্নের মতন ঠেকছিল শংকরের, কিন্তু শরীরের স্পন্দন, মোচড় আর বিস্ফোরণ ছিল পূর্ণ বাস্তব। শংকরের শরীর কাঁপছিল, ওর ঠোঁট কাঁপতে লাগল, ও কাঁপা কণ্ঠে ডাকল, রানি! আর তখনই শিকড় থেকে উপড়োনো গাছের মতন ওর ওপর ধসে নেমে এল রানির দেহ, আর রানির কণ্ঠ থেকে একটিই বিস্ফোরক ধ্বনি, ‘রাজা’!
শংকরলাল এবার আরেকটু স্পষ্ট করে দেখতে চাইল দূরে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকা রানিকে। ওর মনে হল রানির খুব তৃপ্তি হয়েছে এই মৃত্যুতে। যেমনটি চেয়েছিল প্রায় তেমন তেমন। শংকরলাল অস্ফুট স্বরে ডাকল, রানি! ওর মনে হল রানি চাইলে এখনও সাড়া দিতে পারে। ওর এও মনে হল রানির ঠোঁটটা বুঝিবা একটু কেঁপে উঠল। কিছু বলতে চাইছে। রানি? কী বলবে ওকে রানি এখন? কী বলার আছে। সবই তো শেষ। শংকর দেখল, রানির শরীরটাও একটু কাঁপছে। কাঁপল কি সত্যি? শঙ্কর আবার অস্ফুষ্টভাবে ডাকল, রানি। আর ঠিক তখনই দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসা রানির শরীরটা সড়সড় করে ঢলে পড়ল ডান পাশে। আর ওর বাঁ স্তনের ঠিক নীচের তীব্র ক্ষতটা ভাস্বর হয়ে উঠল। পাঁজরভাঙা, প্রাণ-নিঙড়োনো ক্ষত। শংকরের আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না। ও সিঁড়ির দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটতে থাকল, মেয়েদের ভিড় ঠেলে ঠেলে। প্রতিটি মানুষকে ওর একেকটা দরজা মনে হল। দরজা পেরোনোর চেয়েও ওর কাছে কঠিন কাজ মনে হল এই মানুষ পেরিয়ে পেরিয়ে যাওয়া। বাবা বলতেন, একটা দরজা পেরিয়ে বাইরে যাওয়া মানে এক সত্য থেকে আরেক সত্যে যাওয়া। অজয়ের সঙ্গে এই বাড়িতে প্রথম ঢুকেও ওর মনে হয়েছিল এক আলাদা বাস্তবে প্রবেশ করছে। সেই যে প্রথম দিন অজয় রাগ করে চলে গেল তারপর আর ফিরে আসেনি কখনো। কিছুদিন এপাড়ার অন্য এক মেয়ের ঘরে যাতায়াত শুরু করে এবং সবাইকে বলতে থাকে শংকরলাল ওর বান্ধবীকে কেড়ে নিয়েছে। কী প্রয়োজন ছিল ওর একথা রটানোর? শংকর সত্যিই তো কাউকে কেড়ে নেয়নি কারও কাছ থেকে। কারও কিছু কেড়ে নেওয়াতেই ওর বিশ্বাস নেই। কিছুকে ধরে রাখার জন্যও কোনো ব্যাকুলতা নেই ওর। রানিকে কি কখনো ও ধরে রাখতে চেয়েছে? চাইলে সেটা কি খুব সহজ ছিল না? অজয় কেন অমন করে ওর থেকে দূরে চলে গেল? রানির ঘরে সেই প্রথম রাতের পর একবারই অজয় এসেছিল ওর কাছে। ওর মাটিতে পড়ে যাওয়া টাকার পার্সটা ফেরত দিতে। বেশি কথা বলেনি, শুধু রাতের ঘটনার একটা বিবরণ চেয়েছিল। শংকর সত্যি ঘটনাটাই বিবৃত করেছিল বিনা কুণ্ঠায়, বিনা ক্লেশে।