ওর এই রচনাটা হাতে নিয়ে বহুক্ষণ গুম মেরে বসেছিলেন ভবানী স্যার। তারপর ওকে টেবিলের কাছে ডেকে খুব নামানো স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, শংকরলাল, এসব কথার মানে কী? শংকরলালও তখন বুঝতে পারেনি কথাগুলোর মধ্যে দুর্বোধ্যতা কোথায়। শীতকাল নিয়ে রচনা লিখতে গেলে এরকম একটা প্রসঙ্গ তো আসতেই পারে। এ তো কোনো বানানো কথা নয়, শংকর তা নিজে এসব স্পষ্ট দেখেছে। মাত্র একবার যদিও। বাবার হাত ধরে অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়েছিল খিদিরপুর ডকে, আর জাহাজের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে যাচ্ছিল নিধুদা বিলেত যাবে বলে। দিদির সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছে নিধুদার, দেশে ফিরলেই বিয়ে। সে-বিয়ে কোনোদিন হয়নি, আর বিয়ের আগেই বাবা মারা গেলেন। নিধুদা অবসৃত হল শংকরের পরিবারের জীবন থেকে, কিন্তু মৃত্যু হয়েও বাবা থেকে গেলেন শংকরের মধ্যে। হারিয়ে যাওয়া গানের মতন। ভবানীবাবু অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি গল্প লেখ? শংকরলাল ঘাড় নেড়ে বলল, না। ভবানীবাবু বললেন, একটা লিখে দেখিয়ে আমাকে।
রানিকে শংকরলাল বলেছিল, তোমার জীবনী লিখে আমি আমার ইশকুলের স্যারকে পড়ে শোনাব। রানি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল, বলল, আমার জীবনী! আমাদের জীবনে কী আছে বাবু? আমরা তো লাথি খেয়ে বেঁচে থাকা মানুষ। আমাদের জীবন বলেই কি কিছু আছে?
শংকরলাল প্রশ্ন করেছিল, তোমার প্রেম নেই? রানি তখন নীরব হয়ে গিয়েছিল। তারপর বহু মুহূর্ত কেটে যাবার পর বলল, প্রেম তো দিয়েছি অনেক, বাবু। তার কিছুই তো ফেরত আসেনি। তাহলে আর প্রেম কী? তোমাকেও তো আমি ভালোবাসি, কিন্তু তুমি কাউকে ভালোবাসো না। তাহলে প্রেম কোথায়? শংকরলাল জিজ্ঞেস করল, কী করে প্রেম আসে রানি?
আমাদের কাছে প্রেম ফেরত আসার পথ নেই। কেউ টাকা দিয়ে ফেরত দেয়, কেউ ছুরি। দিয়ে। ছপ্পন ছুরি মেয়েটি প্রেম পেলে ছুরিতে। তুমি তো জানো।
তুমি কীভাবে ফেরত চাও রানি?
রানির মুখটা একবার খুশিতে আলো হয়ে উঠল, আর তার পরক্ষণেই ভয়ে, ঘৃণায় কালো হয়ে গেল। আবার কিছুটা খুশির ভাব হল মুখে আর তার পরে পরেই আরও ঘন কালো। খুব চাপা কন্ঠে সে বলল, যা পাওয়া যায় না তা চাওয়ার কী মানে?
শংকরলাল ওকে আশ্বস্ত করার জন্য কিছুটা আবেগের সঙ্গে বলল, না চাইতে জানলে কি সব পাওয়া যায় রানি?
–আমি যে প্রেম চাই তোমায় কে বলল?
–তোমার মুখের রং, তোমার চোখের তারা, তোমার গলার আওয়াজ।
—ওসব আমার কেউ নয় বাবু। ওরাই শুধু চায়, আমি চাই না। আমি যা চাই তা পেলে আমারই ক্ষতি।
-কেন?
আমি যে ছুরির প্রেম চাই। সবাই জানবে, সবাই কাঁদবে, ছপ্পন ছুরির মতন সকলে আমারও ইজ্জত করবে তা হলে। ওই ভালোবাসা তোমার নেই বাবু। হিংসা জিনিসটাই তো তোমার নেই।
আমি জানতাম না মেয়েটা ওইভাবে আমাকে বশ করতে চাইছিল কি না। আমি ভিতু লোক সেকথা সবাই জানে, আমার হাতে ছুরি দেখেও ও হেসেছিল বহুদিন। হেসেছিলাম আমিও আমার ছুরি ধরার আনাড়িপনা দেখে। আমার হাত থেকে তখন ছুরিটা কেড়ে নিয়ে আঙুলের নখের পাশে সেটিকে টিপে ধরেছিল রানি। আমি সঙ্গে সঙ্গে করো কী? করো কী করে ছুরিটা নিয়েছিলাম ওর থেকে। কিন্তু ততক্ষণে দু-ফোঁটা রক্ত পড়েছে সাদা চাদরে। রানি সেদিকে তাকিয়ে বলেছিল, দেখো পাপের রক্ত কেমন হয়। আমি সেই রক্তের ফোঁটাতে আঙুল ঠেকিয়ে বলেছিলাম, সব মানুষের রক্তই এমন হয়। শুধু আমার গা কাটলে নীল রক্ত গড়াবে। দেখবে?
এই বলে ছুরি দিয়ে আমার পায়ের বুড়ো আঙুলে ঘসে দিলাম। মত করো অ্যাইসা! বলে চিৎকার করে উঠেছিল রানি। কিন্তু ততক্ষণে আমারও রক্তপাত শুরু হয়ে গেছে। নীল নয়, টকটকে লাল আলতার মতন রং। তাঁর সধবা জীবনে যেমন আলতা লেপে থাকত মা পদযুগলে।
বারান্দায় দাঁড়ানো সব মুখ ও চোখে এখন আমি সেই রং ছড়িয়ে যেতে দেখছি। অবাস্তবতার স্নিগ্ধ রং যেটা। আমি আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলাম, মুছে পাশে ঝেড়ে ফেললাম সেটা। ঘাম নয়, লাল জ্যান্ত রক্ত। রানির দেহের কিংবা আমার কপালের শিরা উপচে বেরিয়ে আসা রক্ত। সেটা ঝাড়তেই পাশের মেয়েটি ত্রাসের সঙ্গে সরে দাঁড়াল। রক্ত পড়ল বারন্দার গ্রিলের ছায়ায়। যে জায়গা এতকাল আমার পদধূলি পেরেই ধন্য হয়েছে। আমার একটু বাসনা হল পাশে কোথাও থুতু ফেলারও। কিন্তু সঙ্কোচ হল, পাছে থুতুর বদলে রক্ত পড়ে। আমি শুধু একটু কাশলাম। আমি বশিরের মাথায় হাত রেখে নম্র কণ্ঠে ডাকলাম, বশির, চল মুঝে পুলিশ স্টেশন লে চল।
বশির নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। শংকরলালবাবু ওকে পুলিশের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলছেন। ওঁর মতন শরিফ লোক এই কাজ করেছে? না, নিজের জান থাকতে বশির একথা বিশ্বাস করবে না। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি-পরা এই ভদ্রলোকটি এ বাড়িতে ঢুকলে বাড়িটি আলো হয়ে যেত। পাশের বাড়ির দালাল আকবর মিঞা আর ২৫৮নং বাড়ির খাদু আর চঞ্চল বহু চেষ্টা করেছে লোকটিকে ফুসলিয়ে নিয়ে যেতে। পারেনি। রানির এই বাড়িকে শংকরলালবাবু বলতেন, হমারা ঘর। মদ বা খাবার আনিয়ে কখনো খুচরো পয়সা ফেরত চাননি। দু-দুবার পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন বশিরকে। একবার রানির তবলচির অসুখ করলে নিজে তবলিয়া সেজে নাচের ঠেকা বাজিয়েছিলেন। পাছে খরিদ্দার ফিরে যায়। বোবা ফুলওয়ালা শুকদেওকে পুজোয় জামা আর পাজামা দিতেন। মাত্র তিন বছর এসেছেন এই মহল্লায়; কিন্তু ভাবটা যেন এ ওঁর নিজের বাড়ি। হোলির দিন সিদ্ধি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলে বাড়ির মেয়েরা ওঁকে কোলে করে তুলে এনে শুইয়ে দিয়েছিল রানির ফরাশে। আর একবার দুটো গানের রেকর্ড এনে বাজিয়ে বাজিয়ে গান তুলিয়েছিলেন তিনটি মেয়েকে দিয়ে। কতদিন কাগজ-কলম বার করে পাতার-পর পাতা লিখতেন আর বলতেন, বশির, এ হল তোদের ইতিহাস। একবার এক মন্ত্রী এ বাড়িতে এসে পর্দার বাইরে থেকে ওঁর মুখ দেখতে পেয়ে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আর একবার কিছু বিলাতি লোক রানির কাছে এলে শংকরলালবাবু তাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন একেবারে বিলাতি ঢঙে, বিলাতি ভাষায়, রানি বলত, ও হচ্ছে রাজা লোক। কোনো কোনো মেয়ে বলত, ‘দেওতা। আর এই লোকটাই এখন ওকে বলছে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।