আমার পিছন থেকে এবার এই বাড়ির এক নম্বর দালাল বশির হঠো সব! হঠো সব বলে ডাক ছাড়তে ছাড়তে আর দু-হাতে ভিড় করে দাঁড়ানো মেয়েদের দু-দিকে ঠেলে সরাতে সরাতে রানির ঘরে ঢুকে পড়ল। তখন পূর্ব দিকের জানালা দিয়ে বল্লমের মতন ধারালো একখন্ড রোদ এসে ঘরের একটা অংশকে বিধেছে। রানির ঘরের সাদা ফরাস এখন রক্তজবার মতন লাল। ঘরের মুখোমুখি দেয়ালে মস্ত আয়নায় সেই লাল ফরাসের প্রতিবিম্ব হচ্ছে, দেয়ালের সবুজ রংকে মলিন করে দিয়ে গোটা ঘরটাকেই এখন একটা লাল চাদরে মুড়ে দিয়েছে রানির রক্ত। ঘরের চৌকাঠ অবধি এগিয়ে ভয়ে, বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল বশির, ওর মুখ দিয়ে শুধু বেরুতে পারল, হায়, আল্লা! তারপরও ওই চৌকাঠের ওপরেই বসে পড়ে ভেউ ভেউ করে ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগল। মেয়েদের কান্নার চেয়ে ঢের বেশি দুঃখ ছিল এই কান্নায়। বশির বসে পড়াতে ওর পিছনে দাঁড়িয়েও আমি রানির লাশটা দেখতে পেলাম ঘরের দক্ষিণ দিকের দেয়ালজোড়া আয়নার নীচে। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে যেন বসে আছে, আর গোটা গায়ে ছুরির গর্ত। গায়ের পোশাক ছুরিতে ছুরিতে ফালা ফালা হয়ে কতকগুলো ন্যাকড়ার মতন ছড়িয়ে আছে শরীরে। সমস্ত দেহে অক্ষত বলতে চোখ দুটো, যা ভয়ে, রাগে ও ভালোবাসায় এখনও জ্বলজ্বল করছে। চোখের মণি দুটো ভীষণ বড়ো হয়ে উঠেছে আর চোখের নীচে অশ্রুর রেখার পরিবর্তে দুটো চওড়া রক্তের ধারা গন্ডদেশ বেয়ে টপটপ করে গলার রক্তে এসে মিশেছে। রানির সমস্ত চুল এখন একটা রক্তের জটা আর তার প্রিয় আয়নাগুলোতে রক্তের মস্ত মস্ত ছিটে, যেন রাত্রে হোলি খেলা হয়েছে। কদিন আগে হোলির দিনেও এই আয়নাগুলোর একই দশা হয়েছিল। তবে সেসময় জায়গায় জায়গায় বাসন্তী আর সবুজ রঙের ছিটেও ছিল। আমি উৎসুক নেত্রে দেখতে চাইছিলাম খুনের ছুরিটা কোথায়, কীভাবে আছে, আমি মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমস্ত ঘরটা দেখছিলাম। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে কয়েক জোড়া চোখ ঘুরে ঘুরে শুধু আমাকে দেখছে দেখে আমি বিব্রত হলাম আর কিছুটা প্ররোচিত হয়েই এবার নিজের দিকে দেখলাম এবং এবারই প্রথম শিউরে উঠলাম ভয়ে ও আতঙ্কে। আমার সাদা পাঞ্জাবি রক্তে ধুয়ে যাচ্ছে, আমার হাতে রক্ত, একেবারে রানির রক্তের মতন রক্ত, আমার পাজামায় রক্ত, আর ডান হাতে ধরা রক্তমাখা একটা কালো বাঁটওয়ালা কসাইয়ের ছুরি। ফলাটা ন-ইঞ্চিটাক হবে, আর তার গা দিয়ে সমানে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে আমার সামনে উবু হয়ে বসে থাকা বশিরের মাথায়। আমি গলা ফাটিয়ে আবার চিৎকার করে উঠলাম, খুন! খুন!
চিৎকার করেই শঙ্করলাল স্তব্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। ওর খেয়াল হয়েছে, পথচারীরা কেন তখন খুন! খুন! বলে ওর সঙ্গে গলা মিলিয়েছিল। বারান্দায় দাঁড়ানো বাইজিটির মুখে আপ, শংকরলালবাবু! কথাটার পুরো মানে ওর মনের ওপর ভেসে উঠল এখন। ওর একটু একটু করে মনে পড়ছিল গতরাত্রের একটা দৃশ্য। ও মেপে মেপে, জায়গা খুঁজে খুঁজে রানির দেহে একটার পর একটা ছুরির কোপ মারছে আর রানি কোপগুলো গুণে যাচ্ছে। এক… দো… তিন… সাত… আঠারো… বত্তিস… পচপন। রানি তৃতীয়বারে ছুরির ঘা খেয়ে বলেছিল, তোমার যতখুশি মারো বাবু শুধু চোখে মেরো না। আমি তোমায় দেখতে দেখতে মরতে চাই। আমার চোখ নিয়ে না বাবু …।
রানি পঞ্চান্ন পর্যন্ত গুনেছিল, তারপর একদম চুপ হলে গেল। সাতবারের পর সে আয়নার নীচে থেকে নড়তে পারেনি। তার আগে ঘরের এদিক-ওদিক ছুটে বেড়িয়েছে। দরজার ছিটকিনিটা খোলার জন্য যখন ও ওপরে হাত বাড়িয়েছিল, তখনই শংকরলাল ওর হাতের ওপর প্রচন্ড কোপটা বসায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনটে আঙুল মাটিতে গিয়ে পড়ে। শংকরলাল ছুরির শেষ আঘাত হেনেছিল রানির বুকের ঠিক মাঝখানে। দুই রক্তাক্ত, সুডৌল গোল স্তনের সূর্যের মাঝখানে। তখন বুকের দুই বোঁটা দিয়েও রক্ত ঝরছে রানির। শংকরলাল দুই বোঁটাতে শিশুর মতন দু-টি চুম্বন দিল আর তারপর ছুরিটা নিজের বুকের ওপর শুইয়ে রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল রানির কোলে। আর এভাবেই বাকি রাতটা কেটে গেল ওর।
শংকরলাল ঘাড় ঘুরিয়ে বারান্দায় দাঁড়ানো মেয়েদের দিকে একবার তাকাল। হাঁ হয়ে ঝুলে পড়া অজস্র মুখ আর বিস্ফারিত গোল গোল চোখে চোখ পড়ল ওর। সকালের রোদ এখন সমস্ত বাড়িটাকে আক্রমণ করেছে, যা দেখা যায় তাই এত স্পষ্ট যে, সবটাকেই ছবি ছবি মনে হয়। আর যা কিছুকেই ছবি মনে হয় তারই সত্যতা যেন বেশ খানিকটা হ্রাস পায়। এরকম একটা আলো ঝলমলে চকচকে অসত্য সকাল বহুকাল আসেনি শংকরের জীবনে। ওর বাবারও মৃত্যু হয়েছিল শীতকালের এক অপরূপ রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে। যেদিন জীবনের সব অবাস্তবতা একত্র হয়েছিল একই সময়ে, একই স্থানে, অদৃশ্যভাবে। শংকরলালের ধারণা সেদিনও ওর জীবনে আলো ঝলমলে সকালবেলা একটা বিশেষ মাহাত্ম অর্জন করে, কালো মিশমিশে রাত্রির চেয়েও গভীরতর রহস্যময়তায়। তাই ইশকুলে বাংলা রচনার খাতায় ও লিখে বসেছিল,
একেকটা উজ্জ্বল সকালে মানুষ তার মৃত্যুর দিন অবধি সমস্ত ভবিষ্যৎকে পরিষ্কার দেখতে পায়। সে জাহাজের বন্দরে দাঁড়ালে দৃষ্টির বাইরের লুপ্ত জাহাজ ও নাবিক দেখতে পায়, দিগবলয়ের ওপরের জল আকাশ এবং ওপারের মহাকাশ দেখতে পায়, জাহাজ ডুবির নাবিকের মৃত্যু, জলপরির নৃত্য, গভীর মহাকাশে তারার সমাবেশ এবং সমস্ত শূন্যের পরপারে ঈশ্বরের প্রতিভা দেখতে পায়। এ সকালগুলো খুবই কম আসে এবং সাধারণত আসে না।