এ পাড়ায় মেয়ের সংখ্যা বড্ড বেশি, আর কেউই কোনো ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। খুনের মড়ার পাশে গিয়েও আগে আগে ভিড় করবে তারা। লীলাই প্রথম মড়াটার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বিশ্রী গলায় চিল্লোতে লাগল, আইব্বাস! ভগোয়ান ইয়ে কা হুয়া, রানি খুন হো গিয়া। ওই আওয়াজে বারান্দায় ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো ক-টি মেয়েও মর গয়া! মর গয়া বলে লাফিয়ে লাফিয়ে কাঁদতে লাগল। এটা যে কোনো দুঃখের কান্না নয় তাও পৃথিবীর কারও জানতে বাকি নেই। দুঃখ বলে কোনো অনুভূতি এই সব মেয়েছেলেদের নেই। যেকোনো অজুহাতে গলা দিয়ে জোরে আওয়াজ করা এদের স্বভাব। আমি ওদের একটাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে বললাম, অ্যাই, চপ! মেয়েটা একটু ঘাবড়ে গিয়ে থেমে গেল, তারপর খুব অবাক হয়ে ধরা গলায় আস্তে আস্তে বলল, শংকরলালবাবু, আপ?
সবাই জানে শরিফ আদমি শংকরলালবাবুর এপাড়ায় আসার সময় এটা নয়। সমস্ত ভদ্রলোকের মতন তিনিও নেশা না করে এ-বাড়িমুখো হন না। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা নিপাট বাবুটির এখানে আসার বাহানা হল গান। বাবুটি গান ভালোবাসেন, তবে এখানকার গানে ওঁর মন ওঠার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। শোনা যায় লোকটা নাকি কোথায়, কীসব লেখেন—আল্লাই জানেন। তোমাদের নিয়ে বই লিখছি, এমন কথা তিনি মাঝে মাঝেই বলতেন আগে, এখন সেসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। খুব ভদ্র ব্যবহার বাবুটির, চোখ দুটিও খুব শান্ত, কিন্তু ওই শান্ত চোখে কামনা টলটল করছে সর্বক্ষণ। মেয়েরা বুঝতে পারে। গত এক বছর ধরে রানির সঙ্গে খুব ভাব যাচ্ছিল বাবুটির। ব্যাচেলার লোক, এঘরে ঢুকলে বাড়ি ফেরার নাম করতেন না। আর সব ভদ্রলোকের মতন কাকভোরে টুকটাক করে গলি পেরিয়ে বড়ো রাস্তায় গিয়ে ট্রাম ধরতেন। রানির খুব ডাঁট হয়েছিল এই বাবুটির জন্য। সবাইকে বলত, বহুত পড়ালিখা আদমি হ্যাঁয় উনহোনে। মুঝে উমরাও জানকি কহানি শুনায়ে হ্যাঁয় কই দফে! খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কয়েকজনের কাছে সে এও কবুল করেছিল যে বাবুটির যৌন পিপাসা নাকি অসীম। দস্যু লুঠেরার মতন তিনি প্রবেশ করেন নারীদেহে শরীর ও মন লন্ডভন্ড করার জন্য। রানির ভয়, বাবুটির মধ্যে একটা খুনের প্রবৃত্তি আছে।
বাইজি পাড়ার একটি গল্পের ব্যাপারে শঙ্করলালেরও খুব শখ। এখানকার বহু মেয়ের কাছে। সেই গল্পটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শুনেছে। কাহিনিটা ছপ্লন ছুরির। একদিন এক বাইজিকে ছত্রাখান অবস্থায় পাওয়া গেল তার ঘরে, দেহে ছাপ্পান্নটি ছুরির ক্ষত। খুব সুন্দরী ছিল, প্রেমিকও ছিল প্রচুর, ছুরির ঘা থেকে বোঝা যায় হত্যাকারী গভীর প্রেমিক। শংকরলাল বহুবার প্রশ্ন করেও সঠিকভাবে জানতে পারেনি সেই খুনের ছুরিটা কীরকম ছিল। একবার বাজার থেকে তিনটি ছুরি কিনে সে ওখানকার মেয়েদের নিয়ে দেখিয়েছিল। ওই মেয়েগুলোই নাকি প্রথম আবিষ্কার করেছিল হতভাগিনী বাইজির দেহটি। ছুরিটা পড়েছিল দেহের পাশেই। রক্তে ধুয়ে গেলেও ছুরির চেহারাটা খুব স্পষ্ট ছিল। দৃশ্যটা দেখেই নীনা বলে উঠেছিল, ইয়ে কাম সেলিমনে কিয়া, ইয়ে ছোরি উসকি। অথচ সেই নীনাই কিছুতে মনস্থির করতে পারল না শংকরলালের ছুরিগুলো দেখে। একবার বলে এটা, একবার বলে ওটা, একবার সেটা। প্রতিটি মেয়েরই একটা নিজস্ব বর্ণনা ছিল খুনের ছুরিটা সম্পর্কে, কারও সঙ্গে কারও মেলে না। এর মধ্যে একটি মেয়ের বর্ণনা ছিল আরও অদ্ভুত। সে বলল, পুলিশ এসে ছুরিটা তুলে নিয়ে যাবার পরও সমানে চোঁ চোঁ করে রক্ত পড়ছিল ছুরির থেকে। এত রক্ত পান করেছে যে ছুরি, তা দিয়ে গড়াবে তো বহু রক্ত। আর অপর একটি মেয়ে জানকী দাবি করেছিল যে পুলিশের নেওয়া ছুরিটা দিয়ে খুন হয়ইনি। আড়ালে ডেকে একদিন বলেছিল জানকী, বাবু, ওই ছুরিতে খুন হয়নি। খুন হয়েছে এই ছুরিতে। বলে ন-ইঞ্চি ফলার একটা সাদামাটা কসাইয়ের ছুরি ওর হাতে তুলে দিয়েছিল জানকী। সাপের লকলকে জিভে যে গা-শিরশিরে ব্যাপার থাকে তেমন কিছু একটা ছড়িয়ে ছিল ছুরিটায়। ছুরির বাঁটটা হাতে নিতেই একটা উষ্ণতা অনুভব করল শংকরলাল ওর হাতের পাঞ্জার মধ্যে। ওর কেনই জানি না মনে হল এ ছুরিতে কখনো না কখনো কোনো নরহত্যা হয়েছে।
জানকী এবার ওর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বলল, খুনি সেলিম ছিল না বাবু। সেলিমের বড়ো প্রেম ছিল মেয়েটির সঙ্গে। খুন করেছিল। রাজা মুখার্জি, তোমার মতন খুব শরিফ লোক। খুব পিয়ার ছিল ফিরদৌসের সঙ্গে, কিন্তু বিয়ে করতে রাজি হয়নি। বাইজিকে ঘরে তুলবে না, শুধু ফুর্তি করবে। ফিরদৌস তখন সেলিমের সঙ্গে মিশতে লাগল। আর আমার কাছে এসে রাজার জন্য কাঁদত। এই খবর পেয়ে রাজাও এল আমার কাছে, আমার বাবু হল। খুনের পর এই ছুরি এনে আমায় দিল আর বলল, ধুয়ে-মুঝে যত্ন করে রেখে দাও। পরে নেব। তারপর অনেকক্ষণ চুপ থেকে জানকী বলল, আর আসেনি রাজা।
আমি ছুরিটা ওর থেকে কিনতে চাইলাম, জানকী বলল, তুমি এমনিই নিয়ে যাও বাবু। ওদিয়ে আমি কী করব? ছুরিটা আমি রেখে দিয়েছিলাম রানির কাছে। রানি ঠাট্টা করে বলত, এই দিয়ে শংকরলাল একদিন কোপ্তা করবে আমাকে। আমি তখন ছুরিটা ঘুরিয়ে দেখতাম। খুব অকারণ হিংসে হত অদেখা, অপরিচিত রাজা মুখার্জির ওপর। তখন নিজের মনেই হাসতে হাসতে বলতাম, হবে, টাইম আসুক।