এক-একটা কাবাবের টুকরো গোটা গোটাই সেঁধিয়ে যাচ্ছিল নীতিনের কণ্ঠনালীতে। ডিকিদা-র অনুপস্থিতিতে কেউ আসেনি মানে? তখনই তো আসল মোচ্ছব চলত এ বাড়িতে। নীতিন প্লেট থেকে চোখ তুলে চাইল শীলার দিকে। দেখল শীলাও সেই কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে ওকে। ওর যে দৃষ্টি প্রথম দেখেছিল সাত বছর আগের মেঘলা সকালে।
শীলার হাতে স্কচের গেলাস। কিন্তু আসল মদটা ওর চোখে। নীতিন চোখ নামিয়ে নিল। ডিকি ফের ওর গেলাসে মদ ঢালতে ঢালতে বলল, তুমি বড় স্লো যাচ্ছ ব্রাদার, কুইক! কুইক! শীলার জন্মদিন আজ, আজ বটমজ আপ হতেই হবে।
বটমজ আপই হল। কিন্তু মেঝেতেই ফ্ল্যাট হয়ে পড়ল ডিকি। বোতলের সত্তর ভাগ একাই ধ্বংস করার সাক্ষাৎ প্রতিফল। ওকে ধরাধরি করে বিছানায় নিয়ে ফেলল শীলা আর নীতিন। স্বামীকে শোয়ানোর পর কী ভেবেই যেন ছোট্ট, গোল, ফুলদানি রেলিঙের বারন্দাটায় গিয়ে দাঁড়াল শীলা। বোধ হয় রাতের আকাশের তারা দেখতে।
একটু পর ওর পিছনে গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়াল নীতিন। শুনল ওপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই বলছে শীলা, কাল দুপুরে একবারটি আসবে এখানে? অসুবিধে হবে?
অনেক দিন পর ফের গলা ভেঙে গেল নীতিনের ছোট্টো বাক্যটা বলতে, না, না, আসব। কোনো অসুবিধে নেই।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সাতটা বছরকে মাত্র সাতটা দিনের মতো ধরে ফেলতে পারছে নীতিন। আবার সবই কীরকম ফসকে ফসকেও যাচ্ছে। আসল বস্তুটি যত কাছে আসছে। স্মৃতিগুলো চশমার কাচে বৃষ্টির ফোঁটার মতো হয়ে পড়ছে। নীতিন কড়া নাড়ার আগেই দরজা খুলে গেল। নিশ্চয়ই ওর আসার ওপর বারান্দা থেকে নজর রেখেছে শীলা। হে ভগবান, শেষে এই দিনটাতেই ও চোখ তুলে এই কপালের ওপর চুলের গোছার মতো ঝুলে থাকা বারান্দাটাকে দেখতে ভুলে গেল!
শীলার পরনে কি সেই প্রথম দিনের লাল শাড়ি? অতশত বুঝতে পারল না নীতিন। শাড়ি নিয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। শীলা বলল, সকালে মাথাটাথা ধরেনি তো?
নীতিন লজ্জায় হেসে ফেলল, না ওরকম আমার হয়টয় না।
শীলা সম্ভবত ঠাট্টার ছলেই বলল, কী হয়টয় তোমার?
বেশ ঝাঁঝের মাথায় নীতিন উত্তর করল, আমার কিছুই হয় না।
সবজান্তা ভাব করে শীলা বলল, তা আমি জানি। সাত সাতটা বছর দেখছি তো!
–তার মানে? তুমি আবার কী দেখলে?
—কেন রাস্তা থেকে চোখ তুলে তুমিই শুধু দেখো। বারান্দা থেকে নীচে চেয়ে আমি কিছু দেখতে পাই না বুঝি?
-ও তাই! তা কী দেখতে পাও?
–গুমোর! বাবুর গুমোর।
গুমোর! নীতিন আকাশপাতাল হাতড়ে হদিশ পেল না ওর কোথায় কী গুমোর। কেনই বা! শীলার সঙ্গে ওর কী টক্কর। ও আস্তে আস্তে গিয়ে বসল একটা মচমচে বেতের সোফায়। আর বলল, তাহলে ডেকে এনে কেন একথা বলোনি আগে?
ফোঁস করে উঠল সেই আদি অকৃত্রিম থির বিজুরি, কী বলিনি?
রবিন, সুজয়, টমি তোমায় বলেনি আমি ডেকেছি?
মাথায় ওই গোল বারন্দাটাই ভেঙে পড়েছে বোধ হয় নীতিনের। এতজনকে ডেকে খবর দিয়েছে, কিন্তু হারামিরা কেউ একথা জানায়নি ওকে! এত নীচ ওই তথাকথিত ভদ্রলোকের ছেলেগুলো? ওর তথাকথিত বন্ধুগুলো?
কিন্তু মুখ দিয়ে নীতিনের বেরুল, হ্যাঁ, তা বলেছিল। পরাস্ত কণ্ঠে শীলা বলল, তাই না শেষে দাদাকে দিয়ে পাকড়াও করে আনতে হল।
একটা হালকা রোমাঞ্চ বোধ করল নীতিন। ভেতরে ভেতরে কৃতজ্ঞ বোধ করল বন্ধুদের প্রতি। নাই বা খবর দিয়েছে। না হলে এভাবে, এই সমাদরে হয়তো আসা হত না সোনালি তামাকের রঙের … নীতিন মনে মনে শীলার গোটা শরীরটা দেখতে শুরু করেছে। তোক না পরের বর্ণনায় জানা, কল্পনাটা তো নিজের। চাইলেই তো এখন মিলিয়ে দেখা যায় বাস্তব আর কল্পনাকে। নীতিন বেতের সোফা ছেড়ে উঠে এসে বসল শীলার পাশে খাটে। হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ধরল। উহ কী উষ্ণ হাত। একটা মৃদু চাপ দিল হাতে। চাপটা ফিরিয়ে দিতে শীলা বলল, তুমি তো ডাক্তার। একটা উপকার করবে?
—কী উপকার বল?
—ক-টা ইঞ্জেকশন দিয়ে যাবে এসে এসে ক-দিন?
-ইঞ্জেকশন! কেন? কী হয়েছে শীলার? প্রশ্ন তো নয়, কতকগুলো চাপা উৎকণ্ঠা। যা মুখ গলে বেরোয় না।
শীলাই ফের বলল, তোমার দাদাই ধরে আনে রোগটা বাইরে থেকে। আর আমায় দেয়। এই নিয়ে তিনবার হল। আমার আর ডাক্তারের কাছে যাবার মুখ নেই গো। গতবারই ওয়ার্নিং দিয়েছে এভাবে চললে বিশ্রী কিছু ঘটে যেতে পারে। কিন্তু ফের ধরেছে, লজ্জার কথা আমি কাকে বলব বল তো?
নীতিন শীলার হাত থেকে হাত তুলে নিয়ে খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কেন বলেছ তো একজনকে অন্তত। আমি কাল ওযুধ আর সিরিঞ্জ এনে ইঞ্জেকশন দিয়ে যাব তোমাকে। তবে তোমার আগের প্রেসক্রিপশনটা পেলে ভালো হয়।
শীলা বলল, আছে! এই নাও। বলে ব্লাউজে হাত গলিয়ে বুকের ভেতর থেকে বার করে আনল একটা দলা পাকানো কাগজ। নীতিন বুঝল রবিন হোক সুজয় হোক টমি হোক বা সুবিমল ভুল বলেনি। যদিও কোনো প্রমাণ নেই যে তারা বানিয়েও বলেনি। সুডৌল কুমারী স্তন শীলার, সোনালি তামাক রঙের ত্বকও কুমারীর মতো অবয়সি, আপন উষ্ণতায় ও স্বেদে ভিজিয়ে ফেলেছে কাগজের টুকরোটাকে।
শেষ বাইজি
রক্তের ধারাটা দোতলার ঘরটির চৌকাঠ ডিঙিয়ে, বারান্দা অতিক্রম করে, সিঁড়ি বেয়ে একতলার উঠোনে এসে পড়ে ক্রমে উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় নেমে যখন বড়ো রাস্তায় দিকে এগোতে থাকল দু-চারজন পথচারী আমরা খুন! খুন! চিৎকারে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লাম ঘটনার সাক্ষী হওয়ার অপরিহার্য বাসনায়। রক্তের ধারা দেখলেই ‘খুন!’ বলে রব তুলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। খুন!’ ডাকটা প্রথম তুলেছিলাম আমি, কারণ এমনতর রাস্তায় রক্তপাত মানেই খুন, মানে প্রচন্ড কেচ্ছা। উপরন্তু বসন্তের উজ্জ্বল, পরিচ্ছন্ন সূর্যালোকে রক্তের রংটাকে খুব লাল ও নাটকীয় ঠেকছিল। গত তিন বছরে এ পাড়ায় আমরা কোনো হত্যা দেখিনি; টুকরো-টাকরা, দৈনন্দিন রক্তপাত কিছু ঘটেছে, তবে যেরকম খুনখারাপি হলে পাড়াসুদ্ধ সবাই আমরা কিছুদিন ধরে প্রবল উত্তেজনায় দিন কাটাই, নিজেদের কথাবার্তাতেই নিজেরা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তেমন ঘটনা কিছু সত্যিই ঘটেনি। গত বছর একটি মেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিল বটে, তারও কিছুদিন আগে গায়ে আগুন দিয়ে মরেছিল আরেকজন, কিন্তু প্রবল রক্তপাতের যে একটা অদ্ভুত আস্বাদ আছে তা পুরো তিন বছর পর এই প্রথম আমরা পেতে চললাম। আমি উঠোন অব্দি পৌঁছে ফের গলা ফাটিয়ে হাঁক দিলাম ‘খুন!’