এরপর কোনো একদিন হয়তো অ্যান্থনি বলেছিল, কিংবা সুবিমল, কিংবা সুজয়, কিংবা…কী এসে যায় কে সেটা? কিন্তু কেউ একজন ছবি বর্ণনা করার মতো করে বর্ণনা করেছিল শীলার শরীর। সোনালি তামাকের রঙের টানটান চাবুক শরীর। কিছুটা রোমশও, আবার তা সত্ত্বেও মসৃণ। বড়ো উষ্ণ শরীরও, একটা পর্যায়ে নদীর মতো ঘামে। তখন চোখ দুটো এত বড়ো হয় যেন মানুষের চোখের কোটরে বাঘিনির আইবল। তখন কপালের টিপটাও যেন শুক্ল পক্ষের চাঁদের মতো ফড়ফড় করে বাড়তে থাকে। আর বুকের…
নীতিন আর শুনে উঠতে পারেনি বাকিটুকু। হঠাৎ বাথরুম করতে যাওয়ার বাহানায় উঠে গেছে। তারপর পাড়ার বারোয়ারি টয়লেট ফণীদার গ্যারেজের পাশের দেওয়ালের সামনে অকারণ গুম হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল এইমাত্র শোনা কথাগুলোর মানে নিয়ে। আসলে নিজের মনে দেখতে লাগল সোনালি তামাকের রঙের শরীরটাকে। যার সঙ্গে ছোট্ট, গোল, ফুলদানি রেলিঙের বারান্দায় দাঁড়ানো শরীরটাকে মেলানো বেশ কঠিন। একই শরীর, অথচ পরিবেশ ও স্থানবিশেষে কত আলাদা। বহুক্ষণ এভাবে দেয়ালমুখো হয়ে দাঁড়িয়ে শেষে বাড়ি চলে গেল নীতিন।
আর সে-রাতেই প্রথম আধা ঘুম, আধা জাগরণে শীলাকে দেখল নীতিন। ওর মনে হল ওর বন্ধুরা শুধু ডিকি গোমেসকেই নয়, ওকেও ঠকিয়েছে। এক মূখের পায়ের তলায় তো হামেশাই কোনো জমি নেই, শুধু জল; আরেক মূর্খের মাথার ওপর কোনো ছাদ নেই, মেঘ নেই, আকাশ নেই, শুধু একটা বারান্দা।
মেডিক্যালের ছাত্র হবার প্রথম দিনগুলোর উত্তেজনায় বন্ধুদের মনে মনে ক্ষমা করে দিল নীতিন। ওর তখন বেশ কিছু সহপাঠিনী। কারো শাড়ি। কারো সালোয়ার-কামিজ, কারো লং স্কার্ট ওর ভালো লাগে; কারো হাসি, কারো রাগী, গোমড়া মুখ, কারো ফ্যালফেলে চাউনি ওর চোখ টানে। কিন্তু সন্ধ্যেকালে রোয়াকে বসে ওর শোনা চাই রবিন নয়তো সুজয় নয়তো টমির মুখে শীলার কথা, শীলার বর্ণনা। কোনোদিন দুপুরে কাকে ভুনা কারি বেঁধে খাইয়েছে, কাকে পর্ক ভিন্দালু খাওয়ানোর কথা দিয়েছে। কাকে চুরি করে খাইয়েছে ডিকির আনা স্কচের বোতল থেকে এক পেগ জনি ওয়াকার। এরা সবাই এখন ডিকির ন্যাওটা। মস্তান ডিকি এখন ঘুষোঘুষি কমিয়ে পাড়ার এইসব কলেজ-করা ছেলেদের সঙ্গে সময় কাটায়। জাহাজ থেকে ফিরে পার্টি জমায় এদের সঙ্গে। মাল টেনে বারোদুয়ারিতে বেহুশ হয়ে পড়লে এরাই কাঁধে করে তুলে দিয়ে যায় পাঁচতলার আস্তানায়। টানটান করে শুইয়ে দেয় বিছানায়। তখন চোখবোজা ডিকি টিপিকাল সাহেবি অ্যাকসেন্টে বলে দেয়, থ্যাংক ইউ ব্রাদার, থ্যাংক ইউ।
নীতিন বুঝেছিল জাহাজি ডিকির পক্ষে শীলার ওপর বারোমাসি দখল রাখা অসম্ভব। ডিকি নিজেও জানত যে ও আসলে একজন পার্টটাইম স্বামী। খোলসা করে বলতে গেলে—একজন সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান পার্টটাইম স্বামী।
এই ডিকিদা কাল বলতে গেলে জোর করে নীতিনকে টেনে নিয়ে এসেছিল ওর রোমাঞ্চকর ফ্ল্যাটে। সদ্য জাপান ট্যুর করে ফিরেছে জাহাজ। ডিকিদা-র পকেট ভরতি লাকি স্ট্রাইক সিগারেট। গায়ের র্যাংলার জ্যাকেটে উগ্র সেন্টের গন্ধ। মুখে হুইস্কির সোঁদা ঘ্রাণ। বোঝাই যায় ট্রিপের টাকা এখন উথলে উঠছে পকেটে। তবু শেষ বারের মতো মিনতি করল নীতিন, ডিকিদা, থাক না! আরেক দিন হবে এখন।
হাত ছাড়েনি ডিকি। কবজিতে এখনও দেদার জোর। চুলে আঙুল চালিয়ে বলল, আর কবে হবে নীতু? দেখছ না কত পাক ধরেছে চুলে? দাড়িও পেকেছে। একদিনও তো বউদির সঙ্গে দেখা করতে এলে না। জানি ডাক্তার হচ্ছ শিগগির, তা বলে মুখ দাদাদের ভুলে যাবে? তোমাকে লাটাই ধরে ঘুড়ি ওড়াতে শিখিয়েছিল কে?
হে ভগবান, তাই তো! নীতিনের মনে পড়ল কবেকার সেই দিলগুলো। লাহাদের বড়ো ছাদে লাটাই ধরে ঘুড়ি ওড়ানোর হাতেখড়ি হয়েছিল এই ডিকিদা-র কাছেই। তখন চশমা হয়নি নীতিনের, কাচে জল লাগার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু ঘুড়ি উড়িয়ে একাগ্র চিত্তে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার অভ্যাসেরও শুরু সেই। তার অনেক দিন পরে একবার চশমায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে ওপরে চেয়ে এক নতুন খেলা শিখল নীতিন। গত সাত বছরে ফলে আর বিশেষ একটা বারান্দার দিকে নজর না তুলে ওর কিছুতেই মিন্টো লেন পার হওয়া হয় না।
সেই থেকে কপালের ওপর এক গোছা চুলের মতো ঝুলে আছে একটা বারান্দা।
নীতিন ডিকির পিছন পিছন উঠে গিয়েছিল ১০নং মিন্টো লেনের পাঁচতলার ওই ফ্ল্যাটে।
গতকাল খুব দূরের ঘটনা-নীতিন ভাবল মনে মনে। খুব স্কচ খাইয়েছিল, ‘ডিকিদা, কিন্তু সন্ধেটা মন থেকে মুছে যায়নি। ওর গেলাসে মদ দিতে দিতে বলেছিল ডিকি, দিস ইজ জনি ওয়াকার ব্ল্যাক লেবেল, নট রেড। এর জাতই আলাদা। মদে ঢোক দিতে দিতে এক নজরে নীতিন দেখছিল শীলাকে। কে বলবে সাত-সাতটা বছর কেটে গেছে এর মধ্যে। তিন তিনটে মিস ক্যারেজ হয়েছে। ফলে মহিলা এখনও মা হননি। তার বেদনা কি কোথাও বাসা বেঁধেছে মুখে? নীতিনের ডাক্তারি চোখ কিছুই খুঁজে পেল না।
হঠাৎ নীতিনের প্লেটে কাবাব ঢালতে ঢালতে ডিকি বলল, জানো নীতু, আজ আমার বউয়ের জন্মদিন। শি ইজ থার্টি টুডে। কিন্তু আমি শালা তোমার বন্ধুদের কাউকে ইনভাইট করিনি। ওরা সবাই বিট্রেয়ার। কেউ আমার পাশে দাঁড়ায়নি কখনো। শুধু পার্টি করতে এসেছে। যখন আমি মোটা মোটা ক্যাশ নিয়ে এসেছি। যখন ফের জাহাজে গেছি সব সুখের পায়রা উড়ে গেছে যার যেখানে খুশি। তোমার বউদির কোনো সুবিধে-অসুবিধে কেউ আসেনি দেখতে। শালা…