১০ নং মিন্টো লেনের সমস্ত সত্তা মুছে গিয়ে একটা ছোট্ট, ফুলদানি রেলিঙের বারান্দা হয়ে আছে। সাত-সাতটা বছর।
যবে থেকে ডিকির বউ হয়ে এসে দুপুরে, সন্ধেয় বারান্দায় এসে দাঁড়ানো শুরু করল শীলা। লাল কিংবা পুঁতে শাড়িতে জড়ানো এক ঝলক সূর্যরশ্মিই যেন। কখনো পান কখনো লিপস্টিকে এমন লাল ঠোঁট যেন স্টেজে দাঁড়ানো নায়িকা। একরত্তি গোল, ফুলদানি রেলিঙের বারান্দার স্টেজে দাঁড়ানো নায়িকা।
আর পাড়ার সমস্ত উঠতি যুবক যার দর্শক, যার ফ্যান। গত সাত-সাতটা বছর নীতিন গলির রাস্তাটুকু হেঁটে পার করতে পারেনি একবার অন্তত ওই কপালের ওপর ঝুলে থাকা চুলের মতো ওই বারান্দার দিকে এক ঝলক না তাকিয়ে। রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে কতবারই না মনে হয়েছে পাড়ায় আর একটিও বাড়ি, একটিও দরজা, একটিও জানলা নেই। আছে শুধু একটা বারান্দা, আর তার ওপর একটা থির বিজুরি রক্তমাংসে বাঁধা।
সাত বছর আগে স্কুলে যাওয়ার পথে নীতিন প্রথম দেখে দৃশ্যটা। হয়তো সেদিন পরীক্ষা ছিল, তাই বেশ হড়বড়িয়েই হাঁটছিল নীতিন ট্রামরাস্তার দিকে। খান তিনেক ফাউন্টেন পেনের ভারে বাঁ দিকের বুক পকেট হেলে পড়েছে, ডান হাতে খান চারেক মোটাসোটা বই। একটা মুখস্থ করা উত্তরের শুরুর বাক্যটাই হয়তো মনে মনে রগড়াচ্ছিল, ফলে চোখ ছিল চিন্তার ভারে মাটির দিকেই। যখন কোত্থেকে এক ফোঁটা জল এসে পড়ল চশমার কাঁচে।
কাচের ওপর ঝাপসা ফোঁটাটা যে জল তা প্রথমে বুঝতেই পারেনি নীতিন। ও দেখল বাঁ চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে। নাকি ডান চোখের? না দু-চোখেরই? ও কী হয়েছে বুঝতে মাটির থেকে চোখ তুলে আকাশের দিকে চাইল। অমনি আরও কয়েকটা ফোঁটা হাওয়ায় উড়ে এসে চশমার দুই কাচে পড়ল। আর তখন নীতিনের প্রথম খেয়াল হল যে আকাশে মেঘ করেছে, নীলচে অন্ধকার একটা ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশে, বেশ জোরে হাওয়া বইছে আর বৃষ্টির উড়ো ফোঁটাও ঝরছে এখানে ওখানে।
আর ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে ঝাপসা চশমা দিয়েই নীতিন দেখে ফেলল ১০নং মিন্টো লেনের ছোট্ট, গোল বারান্দায় লাল শাড়ি বিদ্যুৎটিকে।
পাড়ার সব ছেলের মতো নীতিনেরও হিসেব আছে পাড়ার কোন বাড়ির কোন বারান্দায় কোন মেয়ে দাঁড়ায়। আর সকলের মতো নীতিনেরও ছকা আছে কোন বারান্দায় কার দাঁড়াবার সময়টা কী। ১০নং মিন্টো লেনের ওই বারান্দায় কোনো মেয়ে দাঁড়ায়নি কোনো দিন। ওটা মস্তান ডিকি গোমেসের বারান্দা, যেখান থেকে ক্কচিৎ কখনো মাঝরাত্তিরে মাতালের হুঙ্কার শোনা যায়। কখনো সখনো মাতালদের কোরাস গান। যখন সারাপাড়া টের পায় জাহাজের মসালচি ডিকি গোমেস মোটা কামিয়ে মাস দুয়েকের মতন ডাঙার বাসিন্দা হল।
নীতিন ভাবল, মেয়েটি কি তাহলে ডিকিদার বউ? ভেবেই চমকে উঠল ভেতরে ভেতরে। ডিকিদা ডাঙায় থাকে গড়ে চার মাস, যার দু-মাস যায় পার্টি করে, ফুর্তি করে, পয়সা উড়িয়ে। বাকি দু-মাস যত্রতত্র ধারকর্জ করে। দু-মাস স্যুট-বুটে দুরন্ত ভাবে, দু-মাস নোংরা আকাচা জামায় মদো মাতাল চেহারায়। দু-মাস ডিকি মস্তান পাড়া শাসন করে, উঠতি রুস্তমদের চড় চাপটা টিকটাক মেরে শিব করে রেখে, অন্য দু-মাস ওদেরই পয়সায় বাংলা চোলাই, কাঁচি ক্যাপস্টান খেয়ে। গলাগলি করে রোয়াকে বসে।
ধুর! ও লোকের ও বউ হয় না নিজের মনে জোরে জোরে বলতে বলতে নীতিন অনেকখানি এগিয়ে গিয়েও ফের তাকাল পাঁচতলার ওই বারান্দার দিকে। রক্তমাংসে বাঁধা, বিদ্যুৎটিও কখন জানি গোল বারান্দার গোল রেলিঙ ধরে ঘুরে গেছে ট্রামরাস্তার দিকে। আর, ঝাপসা কাচেও নীতিন আবছাভাবে দেখল শাড়ি জড়ানো বিদ্যুৎ নীচে তাকিয়ে ওর দিকেই।
এরপর হয় বৃষ্টির আশঙ্কায় নয়তো জীবনের প্রথম এরকম সঙ্কোচে নীতিন প্রায় দৌড়তে থাকল ট্রামের জন্য।
সন্ধ্যেবেলায় পাড়ার রোয়াকে বসতেই ভুল শুধরে গেল নীতিনের। লাল-শাড়ি বিদ্যুৎ বাস্তবিকই ডিকির নবপরিণীতা স্ত্রী। মাইরি!’ বলে আঁতকে উঠেছিল নীতিন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিছুটা নিশ্চিন্তও হয়েছিল। মহিলাকে তাহলে মাঝেমধ্যেই আকাশের দিকে চোখ তুলে দেখা যাবে। পাড়ার একটা প্রকৃত কালেকশান হল তাহলে।
পরদিন স্কুলের পথে ফের ওপরে তাকাল নীতিন। কিন্তু বারান্দা খালি। যাচ্চলে! এর কি বারান্দায় দাঁড়ানোর কোনো নিয়মকানুন নেই? কিছুটা পথ পেরিয়ে ফের মাথা ঘোরাল নীতিন। শুধু থমথমে মেঘ দেখল আকাশে; আকাশে বা বারান্দায় কোথাও কোনো বিদ্যুৎ নেই।
সাত-সাতটা বছর কিন্তু খুব কম সময় না—ভাবল নীতিন। এর মধ্যে চার চারটে বছর ডাক্তারি পড়া হয়েছে। নারী ও পুরুষের অ্যানাটমি সম্পর্কে কত জ্ঞান বেড়েছে নীতিনের। সহপাঠিনী কুমকুমের ঠোঁটের চুম্বন পেয়েছে, শরীরের ঘ্রাণ পেয়েছে, স্পর্শ করেছে ওর নরম, সাদা ত্বক। চোখের সামনে দেখেছে ডিকি জাহাজের ডিউটিতে জয়েন করে বন্ধু সুবিমল, কাতু, রঞ্জিত, সুজয়, টমি, অ্যান্থনি, রবিন নিয়মিত যাতায়াত করছে পাঁচতলার ওই রোমাঞ্চকর ফ্ল্যাটে। হয়তো রবিন প্রথম বলেছিল চারমিনার ধরিয়ে ইডেনের ঘাসে শুয়ে, অসাধারণ মেয়েছেলে রে! তুলনা হয় না। একেবারেই পার্ফেক্ট নিমফোমেনিয়াক।
কড়াৎ করে বাজের মতো কথাটা এসে বুক আছড়ে শিরা, রক্তনালী ফুড়ে পেটের মধ্যিখানে কোথাও এসে দাপাতে লাগল। নীতিন বুঝল ওর পেটের মাঝখানটা লাফাচ্ছে। ভয়ে, লজ্জায়, সম্পূর্ণ হতাশায়। ওর গলার আওয়াজ ধরে গেল। ও বলতে চাইল ‘সত্যি? কিন্তু গলা ভেঙে গেল। মেয়েটা নয়, ওর ঘৃণা হল রবিনের প্রতি। কাঁপা কাঁপা হাতে চারমিনার ধরাতে গিয়ে চোখে একটু যেন ঝাপসাই দেখল। আকাশের দিকে মুখ তুলে বুঝতে গেল কাচে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল কি না। কিন্তু কোথাও বৃষ্টির চিহ্নই দেখল না।