আমি কাজকর্ম শেষ করে মাঝরাতে ছুকরিকে ভালো টাকা আর এক পাঁইট রাম দিয়ে বিদেয় করলাম। তারপর বাবার যৌবনকালের এক ছবির সামনে মদের গ্লাস তুলে টোস্ট করলাম—টু ইয়োর ইমটাল কক, ড্যাড! তোমার অবিনশ্বর লিঙ্গকে অভিবাদন, বাবা!
প্রচুর চাইনিজ এনেছিলাম সেদিন, কিন্তু খেলামটা কই? যা খাওয়ার মেয়েটাই খেয়েছিল। পরের পর রাম খেয়ে কখন যে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলাম জানি না, সকালে ঘুম ভাঙল লোকজনের ডাকাডাকিতে। দরজা খুলে দেখি বাবাকে সবাই চ্যাংদোলা করে আনছে। বুড়ো বেপ মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল জাহাজে। পরে জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু নড়ার শক্তি নেই। বাবার বন্ধু ভিকিকে বললাম, আঙ্কল, ওকে বাড়ি আনলে কেন? ওকে তো হাসপাতালে ভরতি করা দরকার।
দেড় মাস পরে হাসপাতাল থেকে ছুটি হতে বাবা বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল, আমিই আসতে দিইনি। ফাস্টলি, বুড়োর টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স কেয়ার দরকার। ওর হাতে ট্রেমর ধরেছে। সেকেণ্ডলি, বাড়ি ফিরলেই বুড়ো ফের রেণ্ডি খুঁজতে বেরুবে। বান্দ্রা চার্চের ওল্ড পিপলস হোমে রেখে আসার সময় খারাপ যে লাগেনি তা না। তবে ওর ভালোর জন্যই করতে হচ্ছিল।
আজ কিন্তু মনে হয় আমি বাবা আউগুস্ত সুককে বড়োরকম শাস্তিই দিচ্ছিলাম। আমি ওকে ওর যৌবন জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করলাম। না হলে বুড়ো হয়তো আরও অনেকদিন বাঁচত। কে জানে!
তবে ফি হপ্তায় যখনই গেছি বুড়োর একটাই অনুযোগ—এখানে সব কিছুই ভালো, টোনি। বাট নো ওয়ান কেয়ারস অ্যাবাউট মাই কক। আমার যন্তরটি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।
একবার তো হোমের ব্যালকনিতে বসে বাপটা কেঁদেই ফেলে—মাই লাভলি কক ইজ ডাইং, সন। ইটস ডাইং। ও খিদেও ভুলে যাচ্ছে।
তখন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি বাড়ি ফিরতে চাও, ড্যাড?
অনেক চিন্তা করে বাবা বলল, নো!
জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
খুব নিশ্চিন্ত স্বরে বাবা বলল, আই ডোন্ট থিঙ্ক আই ক্যান স্ক্র এনিমোর। আর ওই কম্মোটা করতে পারব না।
তখন বললাম অমন ভাবছ কেন ড্যাড? তোমাকে তো জানি, তাহলে তুমি বাঁচবেই না।
বাবা করুণভাবে মাথা নেড়ে বলল, ট্র। কিন্তু এটাই তো জীবন। তারপর একটু থেমে পড়ে বলল, কিংবা মৃত্যু।
আশ্চর্য, যেদিন ভোরবেলায় হোম থেকে বাবার মৃত্যুসংবাদ এল আমার বিশেষ একটা কান্না এল না। বরং মাথায় ভিড় করে এল সেই সব মেয়েদের মুখ যারা ভরিয়ে রেখেছে। আমার শৈশব, বাল্য, কৈশোর আর প্রথম যৌবনের স্মৃতি। যারা সবাই-ই বাবার সংগ্রহ, বাবার সুখের পাত্র, আদরের পাত্রী। যাদের সব্বাইকে বাবা আড়ালে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলত ‘হোল। গর্ত।
এমনকী আমার মাকেও। যে অবিশ্যি আমার সত্যিকারের মা নয়। আমি সেই প্রসঙ্গে আসছি। ডিয়ার ড্যাড কিছু মনে কোরো না। আমি তোমায় তেমন কিছু ঘেন্না করি না, বরং পছন্দই করি। তবে আমার এই স্মৃতিকথা তোমার শোনা দরকার, হেভেন বা হেল যেখানেই থাকো না কেন। এই স্মৃতিগুলো তোমার প্রাপ্য। তোমার জন্যই এই ডায়েরি শুরু করেছি, আর লিখেও যাব। আমি যে কিছুই ভুলিনি।
তোমাকে ভেবেই আজ এপ্রিল ফুলজ ডে-তে খাতা খুললাম। শুধু তুমি আর আমি নই, আমরা সব পুরুষমানুষই খুব বোকা। আমাদের ভালোবাসা বোঝার কোনো ক্ষমতাই নেই। তোমার তো ছিলই না, ভয় হয় আমারও নেই। তোমার হয়তো মনেও নেই আমার জন্মদাত্রী মা রেবেকা স্পিরোজ সুক তোমার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ না পঞ্চম স্ত্রী। যদি চার্চে মন্ত্র পড়ে, আংটি বদল করে শপথ নেওয়াটাকে তুমি বিবাহ বলে মনে করো। মা অবিশ্যি সবসময় বলত, তোর বাবার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে চার্চে, আর তুই হচ্ছিস আমার একমাত্র লেজিটিমেট চাইল্ড। তোর বাবার অন্য বউগুলো হল … না থাকগে।
একটা ব্যাপারে আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করতে চাই না—সাইপ্রাস ছেড়ে আসার জন্য। তুমি যতই কষ্ট দাও মাকে আমরা কিন্তু সব দুঃখ ভুলে যেতাম সকালে ঘন নীল সমুদ্রটার পাশে গিয়ে বসলে। খুব উত্তেজিত থাকলে আমরা ওই নীল জলে সাঁতার দিতাম অনেকক্ষণ। একেকটা বড়ো ঢেউ এসে শরীরের ওপর ভেঙে পড়লে মা চিৎকার করে উঠত–এসো, এসো! আমাকে ভাসাও! আরও জোরে মারো! এই যে আমি চিৎ হয়ে আছি।
এখন বুঝি সমুদ্রের ওই ঢেউ তখন তোমার কাজটা করত। তুমি যে সংসর্গ থেকে মাকে একটু একটু করে দূরে ঠেলে দিচ্ছিলে সেই আহ্লাদগুলো মা কুড়িয়ে নিচ্ছিল জল থেকে। আর আমিও একটু একটু করে নিজেকে ভেবে নিতে শুরু করেছিলাম জলের সন্তান বলে।
বাবা, তুমি কি কখনো জানতে পেরেছিলে মা একটা গোটা বছর ধরে তৈরি হচ্ছিল সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার জন্যে? আমিও পারিনি, তাই যখন ক্রিসস্তোমো ডে স্কুলে শেষবারের মতো মা বলল, তুমি খুব সাবধানে থেকো লক্ষ্মীটি। খবরদার একলা সমুদ্রে যাবে না। বাবার হাত ধরে যাবে। আমি বুঝতে পারিনি আমি মাকে শেষবারের মতো দেখছি। সেদিন গভীর সন্ধেয় সিরিকালিয়ন বিচে পাথরের ওপর মা-র ক্ষতবিক্ষত দেহটা খুঁজে পেয়ে তুমি যখন হাউ হাউ করে কাঁদছিলে আমার চোখ তখন কিন্তু শুকনো। আমার মনে হল মা এখন ঈশ্বরের কোলে, তুমি আর তাকে কষ্ট দিতে পারবে না।
আমি এসবের ছোট্ট ছোট্ট প্রতিশোধ নিয়েছি সারাজীবন। শেষ প্রতিশোধ তোমাকে হোমে পাঠিয়ে, আমি জানতাম তুমি যৌনক্ষুধায় মারা যাবে। আমি কি মার যৌন ক্ষুধা দেখিনি? তখন বুঝিনি মা ওভাবে সমুদ্রকে আঁকড়ে ধরতে চাইত কেন, তবু বুঝতাম সমুদ্রের ঢেউকে কোলে নিয়ে মা বালিয়াড়িতে বিছানা পাতছে।