‘মাইজি!’ বলে ডেকে উঠেছিল ইবাদত। এরকম বলবেন না, মাইজি! আমি তো আপনারই আছি। সিতার তো বাপ-দাদার জিনিস। জন্নত তো কত কাছের ছিল, আর এখন কত দূরের! আমার বলতে আপনি ছাড়া আর কে আছে।
বাতাসের তোড়ে ইবাদতের সব কথা যেন কোথায় উড়ে গেল। বাড়ি ফেরার পথে মা ও ছেলে আবার কীরকম নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। তারপর হঠাৎ একসময় বহুকাল পর গান গেয়ে উঠলেন বেগম অঞ্জুমান আরা দাদা জহিরুদ্দিন খানের তালিমে শেখা মির্জা গালিবের লেখা গজল–
ইবনে মরিয়ম হুয়া করে কোই।
মেরে দুখ কি দয়া করে কোই।।
কথাগুলো কানে যেতে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি ছড়াল সারা দেহে ইবাদতের। এ কী কথা গাইছেন মা! এ কি মার মনেরও কথা? মা কেন গাইছেন?
যদি মরিয়মের মতো কন্যা হয়ে আমার দুঃখে প্রলেপ দেয় কেউ। আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে আম্মার হাতে হাত রাখল ইবাদত। তারপর আম্মার গান শেষ হতে নরম সুরে বলল, আম্মা, অনেকদিন পর ফের দরবারি বাজানোর মন করছে। আপনি শুনবেন?
৩.
সুমন্ত প্রায় নিঃশ্বাস চেপে বসে আছে সম্পাদকের টেবিলের সামনে। সম্পাদক অরিন্দম বসু একটা করে স্লিপ শেষ করে একেবারে গুম মেরে বসলেন।
প্রথমে পাইপ ধরালেন, তাতে গোটা কয়েক সুখটান দিয়ে মুখে একটা আওয়াজ করলেন, হুম।
ভয়ে ভয়ে সুমন্ত জিজ্ঞেস করল, কী মনে হল, অরিন্দমদা?
সম্পাদক বললেন, তুমি কি চাও এই লেখাটা ছেপে আমি আর তুমি গারদে গিয়ে বসি?
-কেন বলছেন এটা?
-কেন? কারণ উস্তাদ ইবাদত হুসেন খান ইজ নো মোর। এ কাহিনি যে ওঁর মুখে শোনা তার কোনো প্রমাণ আছে? এনি টেপ? এনি সার্টিফিকেট? এনি ড্যাম প্রুফ?।
সুমন্ত ধরা ধরা গলায় বলল, না, অরিন্দমদা। কিন্তু এটা তো আমি ফিকশন করেই লিখেছি। ফিকশন!-বেদম ঝাঁঝিয়ে উঠলেন অরিন্দম বসু। একটা অলটাইম গ্রেট মিউজিশিয়ান আর একটা অল টাইম গ্রেট ফিলম হিরোইনের নাম দিয়ে লিখছ আর বলছ ফিকশন!
সুমন্ত বেকুব বনে গিয়ে একটা খড়কুটো ধরার চেষ্টা করল—কিন্তু ওঁদের কেউই তো আর জীবিত নেই।
আরে বাবা, সেটাই তো সমস্যা—এবার ধৈর্য হারাতে বসেছেন সম্পাদক। ওঁদের কেউ নেই তো কী! ওঁদের নামজাদা ছেলেপুলেরা তো আছেন। আর তা ছাড়া জন্নত নামটা তুমি পেলে কোথায়? উনি বলেছিলেন কি?
তোতলামি শুরু হয়ে গিয়েছিল সুমন্তর-নননন-না!
না! আর তুমি সেই নামটা লাগালে? জানতে পারি কেন?
আমম-মমার কেন জানি না মনে হল?
কেন মনে হল? তুমি কি মাইণ্ড রিড করো?
কারণ উনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন যে করেই হোক ওই নামটা আমায় পৌঁছে দেবেন।
আবার চেপে ধরলেন সুমন্তকে অরিন্দম বসু—দিয়েছিলেন কি?
সুমন্ত আমতা আমতা করে বলল, চেয়েছিলেন, পারেননি। কাগজে পড়েননি উনি মৃত্যুর সময় একটা চিরকুটে একটাই নাম লিখেছিলেন?—জন্নত।
সেটা কি তোমার জন্য?
হলে স্যর কাগজটা শেষ অবধি আমার হাতেই এসে পৌঁছোল কেন? সুমন্ত আস্তে করে বুক পকেটে ভাঁজ করে রাখা চিরকুটটা বার করে সম্পাদকের টেবিলে রাখল। তাতে ভীষণ কাঁপা কাঁপা করে উর্দুতে কী একটা লেখা। চিফ সাব সৈয়দদাকে দেখিয়ে নিয়েছিল সুমন্ত। উনি পড়ে বলেছেন, ওতে লেখা আছে ‘জন্নত।
অরিন্দম জিজ্ঞেস করল, এটা তোমার কাছে এল কী করে?
সুমন্ত বলল, ফোটোগ্রাফার বিপুল এয়ারপোর্টে ছবি তুলতে গিয়ে খাঁ সাহেবের বডির থেকে এটা ঝরে পড়তে দেখে। তারপর তুলে নিয়ে কাউকে দেবার মতো পায়নি। তখন ঝগড়া শুরু হয়ে গেছে বডি কোন বাড়িতে আগে যাবে। রবীন্দ্র সদনে আমায় দিয়ে বলল, দ্যাখ, তোর কাজে লাগে কি না। খাঁ সাহেবের বডির থেকে পেলাম।
চিরকুটটা কিছুক্ষণ এক মনে দেখলেন অরিন্দম। সেটা ফেরত দিতে দিতে বললেন, এটা একটা সুন্দর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দাও।
অ্যাবাউট দ্য স্টোরি আই ক্যান ওনলি সে আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড। আমার প্রাণের মায়া আছে, ডিয়ার।
সন্ধ্যেবেলা উস্তাদ ইবাদত হুসেন খাঁর তিলক কামোদ এল পি-টা চালিয়ে প্রায়ান্ধকার ঘরে চুপ করে বসেছিল সুমন্ত। মনে পড়ছিল খাঁ সাহেবের সেই কথাটা—আমি নিউজ পেপারের হেডলাইনে থাকতে চাই না। আমি ইতিহাসে থাকতে চাই, বাবুসাহেব। ঠিক যেরকম এক ছন্দে, ধীরে ধীরে ওর সাক্ষাৎকারটা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন খাঁ সাহেব প্রায় সেইভাবেই একটু একটু করে ওর গল্পটা ছিঁড়ে ফেলল সুমন্ত।
তখন কি ওরও চোখে একটু জল ছিল না!
১০ নং মিন্টো লেন
১০নং মিন্টো লেন কপালের ওপর ঝুলে থাকা চুলের গোছার মতো। হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেও হঠাৎ কখন জায়গা মতন নেমে আসবে। ভুরু ঠেলে ওপরে চাইবার প্রয়োজন নেই, কপালই জানান দেয় সেখানে চুল পড়েছে।
১০নং মিন্টো লেন গলির মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচতলার এক পুরোনো, লাল ইটের ম্যানশন। কয়েক যুগ ধরে এজমালি সম্পত্তি। পাঁচতলা জুড়ে পনেরোটা ফ্ল্যাটেই ভাড়া বসানো। কিন্তু কে কাকে ভাড়া দেয় কেউ জানে না, ভাড়াটেরাই জানে না পাশের ফ্ল্যাটের মালিকানা কার। তাদের অনেকেরই মনে নেই শেষ কবে ভাড়া গুনছে।
১০নং মিন্টো লেনের পাঁচ তলার ছোট্ট, গোল, ফুলদানি রেলিঙের বারান্দাটাই কপালের ওপর ঝুলে থাকা চুলের গোছার মতো। ওই বারান্দার পাশে আরও যে কতকগুলো একই চেহারার বারান্দা আছে, তার নীচে যে আরও চার-চারটে তলা আছে তা চোখে ধরা দেয় না।