অচেতন ছেলের কপালে একটা চুমু দিলেন বেগম অঞ্জুমান আরা। আর মুখ তুলতেই চোখে পড়ল বিছানার পাশে সাইড টেবিলে রাখা স্বামী ইজাজত হুসেন খাঁর ছবিটা। যে-ছবির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে রেওয়াজ করে ইবাদত আর কখনো কখনো আপন মনে বলে— ঠিক লগ রহা, অব্বা? কখনো—মঞ্জিল ঠিক হ্যায়, হুজুর? কখনো একটু ঠাট্টার ছলে, কুছ তো বোলিয়ে, উস্তাদ! ছেলে জানেও না মা আড়াল থেকে সব দেখেন, সব শোনেন।
ভোর রাতে ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে নিজের ঘরে নেমে এসেছিলেন বেগম অঞ্জুমান আরা। তারপর ভোর হতেই ড্রাইভার উমেদ আলিকে বললেন, গাড়ি নিকালো।
সেলিমকে ডেকে বললেন, সাবকা নাস্তা লগাও। আর ইবাদতকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বললেন, মিঞা, কাল বহত পিয়ে হো তুমনে, মুঝে আচ্ছা নহি লগা। অব নহাকে রেডি হো যাও, মুঝে কাম হ্যায় তুমসে। অউর এক বাত আখরি দম তক ইয়াদ রাখনা—পিস্তল খুদকো মারনে কে লিয়ে পয়দা নেহি হুই।
পিস্তল! আকাশ-পাতাল ভাবনা শুরু হয়েছিল ইবাদতের তখনও হ্যাংওভারে আচ্ছন্ন মগজে। আম্মা সাতসকালে হঠাৎ পিস্তলের গপ্পো জুড়লেন কেন!
বাগান থেকে কুড়িয়ে আনা কাল রাতের ছুড়ে ফেলা পিস্তলটা টেবিলে রাখতে রাখতে শেষ কথাটাও শুনিয়ে গেলেন আম্মা—এরপর নিজের গায়ে তাক করার আগে আমার মাথাতেই দেগে দিও। তোমার আব্বার কাছে অনেক কিছুই পেয়েছি, এখন তোমার কাছে এটাই আমার পাওয়ার আছে।
গাড়িতে উঠে আম্মা উমেদ আলিকে নিশানা বলেছিলেন, মেরিন ড্রাইভ। কাল রাতের কারণে লজ্জায় জড়োসড়ো ইবাদত জিজ্ঞেস করতেও পারেনি—মেরিন ড্রাইভে কোথায়?
মা, ছেলে কারও মুখে কোনো কথা কথা নেই। থেকে থেকেই একটা লজ্জার হাওয়া উঠছে ছেলের মনে। সে আড়চোখে মাঝচল্লিশের মায়ের মুখটার দিকে তাকাল—আহা, কী ভীষণ সুন্দরী আম্মা আমার! অথচ কী দুঃখী মুখ! কতদিন ওই মুখে কোনো স্নেহের আদর পড়েনি! কতদিন ছেলে কোলে শুয়ে ও মুখ ধরে আদর করে বলেনি—আব্বা সে ভি ম্যাঁয় তুঝসে জেয়াদা প্যার করতা হুঁ, মা!
একটা ঘোরের মধ্যে ছিল ইবাদত। সেটা ভাঙল গাড়িটা মেরিন ড্রাইভের ঠিকানায় থামতে। চটকা ভাঙতে ইবাদত দেখল বাড়িটা জন্নতদের। ওর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, আম্মা!
আম্মা কোনো জবাব না দিয়ে বেরিয়ে গেলেন গাড়ি থেকে; অগত্যা পিছন পিছন যেতে হল ছেলেকেও। আম্মা দরজায় বেল দিতে ভেতর থেকে এসে দরজা খুলে দাঁড়াল জন্নত!
বিস্ময়ে হতবাক জন্নতও—আন্টি, আপ! বিস্ময়ের ভেতরে কোথাও একটা প্রচ্ছন্ন পুলকও। মাকে নিয়ে ইবাদত তাহলে শাদির কথা পাকা করতে এসেছে। কিছুদিন উখড়া উখড়া থেকে চাপটা তাহলে ভালোই তৈরি করা গেছে। এখন বাকিটা ভালোয় ভালোয় হলে বাঁচোয়া!
জন্নতের মনের কোণে ইবাদতের সেতার বাজতে শুরু করেছে।
অঞ্জুমান বেগম চুপ আছেন দেখে জন্নত ফের বলল, আইয়ে আন্টি!
নীচের হলঘরে পৌঁছে জন্নতকে আম্মা বললেন, বেটি, তোমার মাকে ডেকে দাও।
জন্নত বলল, আপনারা বসুন, আন্টি। আমি মাকে ডেকে আনছি।
অঞ্জুমান আরা বললেন, আজ আমি বসতে আসিনি, বেটি। তুই মাকে ডেকে দে।
চারদিকে মস্ত মস্ত সোফা বিছোনো, কিন্তু অঞ্জুমান আরা বসলেন না। কাজেই দাঁড়িয়ে থাকল ইবাদতও!
একটু পর সিঁড়ি দিয়ে নামতে ওঁদের দাঁড়ানো দেখে চমকে গিয়েছিলেন মেহরুন বাই। সিঁড়ির ডগা থেকেই বলতে বলতে নামলেন, সে কী আপনারা দাঁড়িয়ে কেন, বেগম সাহেবান! কী সৌভাগ্য যে আজ আপনার পায়ের ধুলি পড়ল এ-বাড়িতে! ওরে জন্নত, একটু নাস্তাপানির বন্দোবস্ত করতে বল।
অঞ্জুমান আরা কিন্তু সেই দাঁড়িয়েই রইলেন। বললেন, আজ আমার কিন্তু বসা হবে না, বহেন। তোমার থেকে শুধু একটা কথা জানার জন্য এসেছি।
সোফাগুলোর মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন মেহরুন বাই। ওর পিছনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে অষ্টাদশী জন্নত। অঞ্জুমান বেগম একবার খুব নজর করে নিজের ছেলেকে দেখলেন, তারপর মেহরুন বাইয়ের মেয়েকে। তারপর খুব শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন, মেহরুন, একবারের জন্য আমার ছেলেকে বলে দাও, জন্নত ওর কী হয়?
এক শিশমহলে যেন কোত্থেকে এক পাথর এসে পড়েছে! চমকে উঠে ইবাদত ও জন্নত একে অন্যের দিকে চাইল। কেউ জানে না এরপর উত্তরে কী শুনতে হবে।
মেহরুন মাটির দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন। অঞ্জুমান বেগম ফের বললেন, বহেন, আমার ছেলেকে এইটুকু শুধু বলে দাও—জন্নতের আব্বা আর ওর আব্বা একই কিনা।
মেহরুন তখনও নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে, অঞ্জুমান বেগম ইবাদতকে বললেন, বেটা, একবার নিজের মুখটা দেখো আর জন্নতের দিকে তাকাও। তোমার চোখ, তোমার নাক, ঠোঁট, কপাল সব মেলাও ওর সঙ্গে। কার ছাপ দেখছ, মিঞা?
এবার মাটির থেকে মুখ তুলে মেহরুন বাই বললেন, হাঁ, ইয়ে সচ। জন্নতের বাবা আর ইবাদতের বাবা এক। জন্নত আমার আর উস্তাদ ইজাজত হুসেন খানসাহাবের ভালোবাসার ফসল।
অনেক চেষ্টা করেও আর জন্নতের দিকে মুখ তুলে চাইতে পারল না ইবাদত। আম্মা হেঁটে বেরিয়ে যেতে একবারটি জন্নতের দিকে চোখ ফেলতে দেখল অনামিকার থেকে ইবাদতের দেওয়া সিতারের মেজরাবটা খুলে ওর হাতে তুলে দিচ্ছে জন্নত। হিরের আংটি পরাতে গিয়েছিল প্রেমিকাকে যেদিন ইবাদত, জন্নত আংটি ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল, তোমার মেজরাবটাই আমাকে পরিয়ে দাও, জনাব। যে মেজরাবে সেতারে সুর তোলো তাতেই তো আমিও বাজি। শুনতে পাও না! ফেরার পথে সমুদ্রের পাড়ে বহুক্ষণ বসেছিলেন মা ও ছেলে। একটা কথাও বলেনি কেউ, শুধু উঠে আসার সময় মা বললেন, বেটা, জানি তোমাকে ফের একলা করে দিলাম। কিন্তু এও জেনো যে, আমার চেয়ে একলা কেউ নেই দুনিয়াতে। তোমার তবু সেতার আছে, আমার ছিল বলতে তুমি…