তাহলে আপনার এত আপত্তি কীসের, আম্মা?—প্রায় কাতরোক্তি করে উঠল ইবাদত।
যেহেতু তোমার অউরত হিসেবে আমি ওকে ভাবতেই পারি না—সোজা জবাব দিলেন অঞ্জুমান বেগম।
ইবাদতেরও মেজাজ চড়ছিল একটু একটু করে। বলল, তার মানে জন্নতকেই আপনার পছন্দ না?
বেগম বললেন, খুব পছন্দ। ও সিনেমায় নামা সত্ত্বেও। কিন্তু তোমার বিবি হিসেবে ওকে আমি পছন্দ করব না কোনোদিনই। কিন্তু কেন, আম্মা? এ তো বঢ়ি তাজ্জব কি বাত!—ফের এক কাতরোক্তি ইবাদতের কণ্ঠে।
বেগম গম্ভীর সুরে বললেন, হাঁ বহত তাজ্জব কি বাত। মগর কভি কভি তাজ্জব কি বাত
ভি মাননা, পঢ়তা, মিঞা।
ইবাদত বলল, তা কি আমি মানিনি আগে, আম্মা? আপনি বলেছেন, আমি গান ছেড়ে দিয়েছি। আপনি বলেছেন, আমি কালাপানি পার করেছি। আর এখন আপনি বলছেন, আমার ইশক, আমার পেয়ার, আমার চোখের আলো, মনের প্রদীপ জন্নতকেও ছেড়ে দিতে। এর চেয়ে ভালো ছিল আপনি আমাকে প্রাণপাখিটাকেই ছেড়ে দিতে বলতেন।
অঞ্জুমান বেগম চুপ করে ছিলেন, ইবাদত মাথা নীচু করে বসে রইল অনেকক্ষণ, শেষে দুঃখে ভরাডুবি হতে হতে একটা শের আউড়াতে লাগল :
জুর্মে উলফত পে হমেঁ লোগ
সজা দেতে হ্যাঁয়।
ক্যায়সে নাদান হ্যাঁয় শোলোঁ কো
হাওয়া দেতে হ্যাঁয়।
ভালোবাসার অপরাধে লোকে আমাকে শাস্তি দিচ্ছে… বেশ বলেছেন সাহির সাব। দিন, দিন, দিন, যত পারেন শাস্তি দিন। আম্মা, দোষ তো আমার একটাই—আমি ভালোবেসেছি। তবে জেনে রাখুন মা, আপনার কথা তো আমি ফেলতে পারব না, জন্নতকে আমার ছাড়তেই হবে। কিন্তু অন্য কোনো মেয়েকেও আমি বিয়ে করব না, তাতে ইজাজত খাঁর সেতার বংশ লোপ পেয়ে যাবে।
ইবাদত উঠে গিয়ে নিজের ঘরে ফের বেগম আখতারের রেকর্ডটা টার্নটেবলে চাপিয়ে একটা ড্রিংক নিয়ে বসল। যে খিদেটা কিছুক্ষণ আগে চাড়া দিয়ে উঠছিল ভেতরে হঠাৎ করে সেটা কোথায় মিলিয়ে গেল। হাতে ড্রিংকের গেলাস ধরে আখতারী বাইয়ের গজলের মকতা শের, যেখানে কবি দাগের নাম আসছে, সেই কথাগুলো আসতেই হিজ মাস্টার্স ভয়েসের লেবেলের সেই কুকুরের মতো গ্রামোফোনের একদম পাশে গিয়ে পা মুড়ে বসল ইবাদত। রেকর্ড থেকে বেগম আখতার তখন গাইছেন :
জিসৎ সে তঙ্গ হো
অ্যায় দাগ তো জিতে কিঁউ হো
জান পেয়ারি ভি নেহিঁ
জান সে যাতে ভি নেহি।।
শুনতে শুনতে বিড়বিড় শুরু হল ইবাদতের—জীবনটা যখন এতই দুর্বিষহ তাহলে বেঁচে আছিস কেন কবি? প্রাণের প্রতি টান নেই অথচ মরণও হয় না তোর। রেকর্ডটা থামতে হুইস্কির গেলাসটা শেষ করে ফেলল ইবাদত। তারপর আরেকটা ঢালল, আর নিমেষে শেষ করে দিল। তার পর আবার। সেটা শেষ হতে জন্নতের নম্বর চাইল বোম্বাই টেলিফোন অপারেটরের কাছে—সেন্ট্রাল ফাইভ নাইন সিক্স সেভেন, প্লিজ।
লাইন লাগতে ওপার থেকে সেই নম্র গম্ভীর স্বর—হ্যালো?
ইবাদত জড়ানো গলায় বলল, ইবাদত বলছি।
ওপার থেকে খুবই সংযত স্বরে—বলো।
বলার কিছু নেই, তোমার আওয়াজ শুনব বলে…
শোনা হল তো… রাখলাম।
জন্নত ফোন নামিয়ে রেখেছিল।
জন্নত ফোন নামিয়ে রাখল। প্রথমে কিছুক্ষণ কথাটা বিশ্বাসই করতে পারছিল না ইবাদত। কান থেকে রিসিভার নামাতেও পারছে না। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর রিসিভার আপনা থেকে হাত থেকে খসে পড়ে গেল কার্পেটে।
ইবাদত সেটা তুলে জায়গায় রাখলও না। বরং উঠে গিয়ে আলমারির ভেতরের লকার খুলে দীর্ঘদিনের সঙ্গী পিস্তলটা বার করল। তারপর নিজের কপালের দিকে সেটাকে তাক করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, বাচ্চা, বহুদিন এই মিঞাকে তুই বাঁচিয়েছিস দুশমনদের হাত থেকে। আজ ভালোবাসার লোকদের হাত থেকে বাঁচা!
ইবাদত পিস্তলের ঘোড়া টিপে দিয়ে দড়াম করে কার্পেটে পড়ে গেল। টোটাহীন পিস্তলে ক্লিক করে একটা আওয়াজ হয়েছিল শুধু। বড়ো আওয়াজটা হল জোয়ান মরদের দেহটা হুড়মুড়িয়ে মাটিতে পড়ল যখন।
আওয়াজ শুনে নীচের থেকে দুড়দাড় করে ছুটে এসেছিল বাবুর্চি সেলিম। আর উস্তাদকে পড়ে থাকতে দেখে ওর শোর মচানোয় উপরে উঠে এসেছিলেন বেগম অঞ্জুমান। ছেলেকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে বুকে হাত চেপে একটা আর্তনাদ করে উঠেছিলেন অজুমান আরা। তারপরই সেলিমকে জিজ্ঞেস করলেন, জিন্দা হ্যায় তো?
সেলিম মনিবকে মাটি থেকে তুলতে তুলতে মাথা নেড়ে বোঝাল, হ্যাঁ।
অঞ্জুমান আরা তখন ছুটে গিয়ে ছেলের আঙুলে ফাঁসা পিস্তলটা বার করে জানালার বাইরে ছুড়ে ফেললেন। তারপর ছেলের মাথাটা কোলে নিয়ে কার্পেটে বসলেন মিকেলাঞ্জেলোর পিয়েতা মূর্তির মতো। আর নীরবে চেয়ে রইলেন সেতারের নবীন যিশুর মুখটার দিকে।
অঞ্জুমান আরার মনে পড়ল মৃত্যুশয্যায় স্বামীর কথাগুলো—মিঞার দিকে নজর রেখো, অঞ্জু। ও হমসে ভি বহত, বহত বড়া নিকলেগা। ও হমারে ঘরানেকা তানসেন হ্যায়। উসকো সমহালকে রখনা, অঞ্জু।
বেগমের মনে পড়ল অভাবের সেই দিনগুলো। দুটো ফুলকা আর একটা সবজি খেয়ে রাতের রেওয়াজে বসে ঘুমে ঢলে পড়েছে ইবাদত। টেবিল ফ্যানের তার দিয়ে শক খাইয়ে জাগিয়ে দিয়েছেন অঞ্জুমান। মা!’ বলে চিৎকার করে উঠেছিল ছেলে। মা বললেন, বহত লায়েক বন গয়ে হো, না? সামনে পঢ়ে হুয়ে বন্দির্শে কৌন উঠায়গা? চলো, সিতার উঠাও!
অঞ্জুমানের মনে পড়ল সেইসব সন্ধ্যে আর রাত যখন পাঁচ বছরের ইবাদতকে কোলে নিয়ে লোরি শোনাচ্ছেন আর গায়ে শাল জড়িয়ে স্বামী বেরিয়ে যাচ্ছেন মেহরুন বাইয়ের কোঠার দিকে। তখন বুকের ভেতরটা হু হু করছে ব্যথায়, আর তারই মধ্যে কোথায় যেন একটা স্বর্গের শান্তি। মনে মনে শুধু আওড়াচ্ছেন, আমার আশিককে তুমি কেড়ে নিয়েছ মেহরুন, তো ঠিক আছে। আমার জীবনের নুর, আলো তো এই বুকেই ধরা আছে। ইবাদতের কপালে একটু চুমু দিলেন মা।