আর ঢুকেই মুখে কাপড় চাপা দিয়েছিলেন—হায়, আল্লা! ইয়ে তো বিমার পড়ি! বাকি দিনটাও ঘুমে কাদা হয়েছিল ইবাদত, দুপুরের খাওয়াও বরবাদ হল। সন্ধ্যে সাতটায় ঘুম ঝেড়ে উঠে প্রথম কাজটা হল জন্নতের বাড়ির নম্বর চাওয়া। ফের সেই নায়িকা কণ্ঠে ‘হ্যালো?’ ইবাদত খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, কেমন আছ?
একটা আড়ষ্ট উত্তর এল, ভালো।
ইবাদত বলল, আমার শেষ চারটে চিঠির জবাব পাইনি।
জন্নতের কোনো জবাব নেই।
ফলে ইবাদতই ফের বলল, তোমাকে সারাক্ষণ মিস করেছি।
জন্নতের প্রায় ঠাট্টার সুর-অ!
কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না?
এত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কী আছে?
তোমার-আমার যা মরাসিম, রিশতা, তাতে বিশ্বাসের কথা আসবে না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সম্পর্ক তো আছেই। দূরে সরে থাকার সম্পর্ক।
ওহ! ওহ! ওহ! ইয়ে হি ন বাত? দূরে কি শখ করে চলে গিয়েছিলাম? মা আর মামা মিলে তো জোর করে, ছক কষে পাঠিয়ে দিলেন, যাতে আমাদের টানটা কমে যায়।
—ভালোই তো করেছেন, যা হবার নয়, তাকে বেশিদূর গড়াতে দেননি। এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল ইবাদত, কী হবার নয়! যে সম্পর্কের স্রোত এতদূর গড়িয়ে এসেছে তাকে পিছনে ফেরাবে কে? এত অনুরাগের কথাটার বিশেষ দাগ বোধ হয় পড়ল না জন্নতের মনে। সে ফোন ছাড়ার তোড়জোড় করল—রাখছি। আমায় বেরোতে হবে।
ছাড়বে না ইবাদতও—কেন, কোথায় যাবে?
নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর দিল জন্নত—শুটিঙে।
আর ফোন রেখে দিল।
ইবাদত বিশ্বাস করতে পারছিল না, এ-ই সেই জন্নত যাকে বোম্বাইয়ের জাহাজঘাটায় হাত নাড়তে দেখে আরব সাগরটাকে ওর কালাপানি মনে হচ্ছিল, যা পেরিয়ে ওপারে গেলে আর নাকি ফেরা হয় না। হঠাৎ হাঁটুর কাছটায় খুব দুর্বল ঠেকছিল ওর, কোনোমতে রেলিংটা চেপে ধরে নিজেকে সামলেছিল। আর রাতে কেবিনে চিঠি লিখতে বসে বাইরে সমুদ্রের ঢেউ দেখে একটা প্রিয় গজলের দুটো কলিই লিখে দিয়েছিল
দিলঁ মে এক লহর সি
উঠি হ্যায় অভি!
অউর তাজা হাওয়া
চলি হ্যায় অভি।।মনের মধ্যে ঢেউ আর বাতাসের কথার উত্তরে ওর মা মেহরুনের বহু পুরোনো একটা গজলের দুটো কথা লিখে দিয়েছিল জন্নতও—
আরজুয়েঁ হজার রখতে হ্যাঁয়।
তো ভি হম দিল কো মার রখতে হ্যাঁয়।।
আহা, কী জবাব! হাজারো বাসনা মনে, তবু মনকে রাখি বেঁধে। ইবাদত ধরতে পারেনি কার শের, তাই পরের চিঠিতে লিখল, প্রিয়তমা, তোমার মনের কথাটা কোন শায়েরকে দিয়ে বলালে, গোগা?
সেবার একটা গোটা কাগজে শুধু একটাই কথা লিখে পাঠিয়েছিল জন্নত-মীর!
সেই জন্নতই এখন ফোন রাখতে পারলে বাঁচে।
ইবাদত স্নান সেরে একটা হুইস্কি নিয়ে বসতে যাচ্ছিল, হঠাৎ নীচের থেকে আম্মার ডাক এল—ফুরসত হোত নীচে উতরানা, বেটা!
বুকটা ধক করে উঠল উস্তাদের; এত গম্ভীর করে ডাকলে তো আম্মা অদ্ভুত আবদার জোড়েন। একবার শুনো মিঞা’ বলে পাশে বসিয়ে গভীর রাতে বলেছিলেন, তুমি আমার ভাইসাবদের কাছে গান শিখছ, ভালো কথা। ঢের শিখেছ, এবার বন্ধ করো। তোমার বাপের ঘরের সম্পদ হচ্ছে সেতার, সেই সেতারেই ডুবে থাকো।
বুকটা ব্যথায় মুজড়োচ্ছিল ইবাদতের। করুণ চোখে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন মা? এত ভালো গান আপনার বাপের বাড়ির, সেই গান গাওয়া কি দোষের? আম্মা বলেছিলেন, আর আমার স্বামীর ঘরে যে এত অতুলনীয় এক সিতার বাজ! ইবাদত বলল, কিন্তু আমি যে দুটোই চাই! আম্মা বললেন, তাহলে তুমি আব্বার চেয়ে বড়ো শিল্পী হবে কী করে?
কিন্তু আমি চাইলেই কি আব্বা জানের চেয়ে বড় সেতারি হতে পারি, মা?
তোমার আব্বা তো সেটাই চেয়েছিলেন, মিঞা। আর ওঁর ইন্তেকালের দিন আমাকে দিয়ে শপথ করিয়েছিলেন।
কী শপথ, মা?
যে, এমন করে গড়ব তোমাকে যে দুনিয়া একদিন সিতার বলতে ইবাদত বুঝবে, ইবাদত বলতে সিতার। সেদিন বহু রাত অবধি মা ও ছেলে পাশাপাশি বসে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেছিল। ঊষার প্রথম আলোয় পুত্র বলেছিল, মা, আমি গান ছেড়ে দিলাম। সেতার ছাড়া আর কিছু থাকবে না আমার।
ইবাদত এই সবই ভাবতে ভাবতে নীচে নেমে দেখল টেবিলের উপর আব্বার একটা ফটোগ্রাফ রেখে পাশের কৌচে বসে আছেন আম্মা অঞ্জুমান আরা বেগম। ছেলে আসতে পাশের চেয়ারটার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন।
ইবাদত বসতে মা বললেন, তোমার শরীরে খুব কষ্ট আছে, জানি।
ইবাদত চাপা গলায় বলল, মনেও।
মা বললেন, তাও জানি।
কিন্তু আপনি তো আমার ব্যথা বুঝছেন না। আমি সত্যিই জন্নতকে ভালোবাসি। আপনি ভেবেছিলেন আমাকে বিলাত পাঠিয়ে দিলে আমি ওকে ভুলে যাব।
কিন্তু ও তোমাকে ভুলতে পেরেছে।
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল ইবাদত—কেন এমনটা বলছেন আপনি, আম্মা? বহু কষ্ট চেপে রেখে ও দূরে সরে আছে। আমি শাদি করে ওকে ঘরে তুলে আনতে চাই।
একটা লম্বা সময় চুপ করে রইলেন অঞ্জুমান বেগম। শেষে বললেন, সেটা হবে না।
কীরকম নিষ্ঠুর শোনাল মার কথাটা। ইবাদত এবার একটু রাগত ভাবেই বলল, কেন, ও একজন বাইজির মেয়ে বলে?
অঞ্জুমান বেগম বললেন, কক্ষনো না। আমি একটা গানের ঘরের মেয়ে হয়ে এমনটা মনে করতেই পারি না। তা ছাড়া মেহরুনের মতো গাইয়ে ক-টা হয়েছে দুনিয়ায়?
ইবাদত বেশ অবাকই হয়েছিল আম্মার মুখে মেহরুন বাইয়ের এই প্রশংসায়। হয়তো এই প্রথমবার জীবনে মেহরুনের গানের এই প্রশংসা শুনল আম্মার মুখে। তাই সরলভাবে জিজ্ঞেস করল, কলকাতার বাড়িতে তো কোনো দিনও কোনো রেকর্ড দেখিনি মেহরুন বাইয়ের। তাহলে কোথায় শুনলেন ওনার গান আপনি? আম্মা বললেন, কেন, রেডিয়ো বলেও তো একটা জিনিস আছে। তোমার আব্বার সঙ্গে কম জলসাতেও তো যাইনি এককালে। ভুলে যেও না, মেহরুন একসময় ন-বছর কাটিয়েছে কলকাতায়, হর শাম মেহফিল বসিয়েছে ওর বাড়িতে, তোমার আব্বাও দিব্যি ভক্ত হয়েছিলেন ওঁর খেয়াল গজল ঠুংরির!