ইবাদত মিন মিন করে বলল, আসলে মনটা তো মনই। কিছু বোঝে না স্যর।
চা আসতে কৃষ্ণ মেনন চায়ে ডুবিয়ে বিস্কুট খেতে খেতে বললেন, তাহলে মনটাকে এত পাত্তা দাও কেন? লুক হাউ হ্যাণ্ডসাম ইউ হ্যাভ বিকাম ইন জাস্ট সিক্স মানথস! সাহেবদের মাথা খারাপ করে দিয়েছ এই ক-দিনে। সবাই বলছে ইউ আর দ্য বেস্ট ইণ্ডিয়ান এক্সপোর্ট আফটার ইণ্ডিপেন্সে। বেহালার লেজেণ্ড ইয়াশকা হাইফেজ, হিরোইন ইনগ্রিড বার্গম্যান, জিন সিমনস, হিরো ওয়াল্টর পিজন …এঁদের সঙ্গে তুমি প্রোগ্রামে নামছ, ফেস্টিভাল অব ব্রিটেনের ইউ আর আ স্টার। অ্যাণ্ড ইউ ওয়ন্ট টু গো ব্যাক হোম। আমি বুঝতেই পারি না কেন।
ওঁর কথার তোড়ে ইবাদত ওর কাপে চুমুক দিতে পারছে না দেখে একটু থামলেন কৃষ্ণ মেনন। তারপর স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, হয়তো এই জন্যই তোমরা আর্টিস্ট। আর আমরা …
সাহেবের কথা ঠিক শুনতে না পেয়ে ইবাদত বিব্রতভাবে বলল, আজ্ঞে, আমায় কিছু বললেন, স্যর?
কৃষ্ণ মেনন বললেন, হুম! বলার আর কী আছে? শুধু জানার ইচ্ছে একটাই—তুমি কেন চলে যেতে চাইছ? গিভ মি ইন ওয়ান সিম্পল সেনটেন্স। আমি ওই সব মন-ফন বুঝি না, আই অ্যাম নট অ্যান আর্টিস্ট।
ইবাদতের চোখের সামনে তখন ভাসছে জাহাজঘাটায় ওকে সি-অফ করতে এসে মস্ত জাহাজটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা জন্নতের চোখ দুটো। নদীর জল জলের মতো নীল চোখেও তখন দু-ফোঁটা জল। তার একটু আগেই জিজ্ঞেস করেছিল—আমার সিনেমায় নামায় তোমার এত ভয় কেন, ইবা? ওটা খারাপ লাইন? সঙ্গে সঙ্গে প্রেমিকার ঠোঁটটা ওর ডান হাতে চেপে ধরে বলেছিল ইবাদত, না, না, তা কেন? তা কেন? ওভাবে তো ভাবিই না কখনো।
তাহলে?—তখন অভিমান জন্নতের গলায়।
ইবাদত বলেছিল, শুধু তোমাকে হারাবার ভয়।
জন্নতের সব অভিমান ফের ভর করেছিল গলায়, সেজন্যই জাহাজে করে বিলায়েত পাড়ি দিচ্ছ তো জনাব?
ইবাদতের চটকা ভেঙেছিল কৃষ্ণ মেননের কেতাদুরস্ত অর্ডারের ভঙ্গিতে—আমাকে স্রেফ একটা বাক্যে তোমার কারণ বলো, আমি তোমায় ছেড়ে দেব।
ইবাদত আকাশ-পাতাল বহুত কিছু ভেবে শেষে একটা ছোট্ট বাক্য উগরে দিল—আই অ্যাম ইন লাভ, স্যর।
চব্বিশ দিন ধরে জাহাজে এই একটাই বাক্য আবৃত্তি করতে করতে এসেছে ইবাদত। আই অ্যাম ইন লাভ … আই অ্যাম ইন লাভ … আই অ্যাম ইন লাভ … সুয়েজ ক্যানাল দিয়ে বয়ে যেতে যেতে ডেকে দাঁড়িয়ে বাক্যটা আবৃত্তি করছিল ইবাদত, হঠাৎ মনে হল ওর, এটা খুব সহজ কথা নয়। কোথায় একটা পাওয়ার এবং অথরিটির ছাপ আছে। যেন শেরের মতলা, কবিতার প্রথম কলি। বোম্বাইয়ে বাড়ি ফিরে ইবাদত প্রথম ফোনটা করেছিল জন্নতকে। সাত মাসে আরও সুন্দর হয়েছে ওর কণ্ঠস্বর—হ্যালো।
কোনো ভণিতা নেই, নখরা নেই, কেমন আছ?’ ‘কী করছ?’-র বালাই নেই, ইবাদত এতকাল ধরে মকশো করার পরও প্রায় আনাড়ির মতো কাঁপুনি ধরা গলায় বলল, আই অ্যাম ইন লাভ। তারপর সেনটেন্স কমপ্লিট করার জন্য জুড়ল—উইথ ইউ! কিন্তু ওপার থেকে কোনো স্বর ভেসে এল না। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতার আওয়াজ।
ইবাদত ফের বলল, আই অ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ।
কিন্তু নিস্তব্ধতা ভাঙল না।
ইবাদত আবার বলল, আই অ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ, জন্নত। এবার ফোনটা রেখে দেওয়ার আওয়াজ হল।
সেই সন্ধ্যায় বাড়ির বার হল না তরুণ উস্তাদ, গোটা বোম্বাই শহরটাকে যেন কবরের ঠাণ্ডায় ধরেছে। ও সেতারের রেওয়াজেও বসল না। বহুদিন পর দম দেওয়া গ্রামোফোনটা নামিয়ে ঝাড়ল কিছুক্ষণ। তারপর বিলেত থেকে আনা নতুন পিন লাগিয়ে তাতে একটা রেকর্ড চাপাল। নিজের রেকর্ড? না আব্বাজানের? না। প্রিয় গাওয়াইয়া বড়ে গুলাম সাহাবের? না। প্রিয় আমির খাঁ সাহাবের? তাও না। দু-বছর হল বেগম আখতার সাহেবান ওকে ওঁর এই রেকর্ডটা উপহার দিয়ে বলেছিলেন, আনন্দের সময় শোনার মতো অনেক কিছুই আছে তোমার। এটা রাখো কোনো দুঃখের রাতের জন্য, ইবাদত।
এমনিতেই দুঃখে ডুবে থাকা স্বভাব ইবাদতের, নতুন করে বেদনা জাগানোয় বড়ো ভয়। আজকের মনের ব্যথায় সেই ভয়টাও যেন উবে গেছে। ও চোখ মুছতে মুছতে টার্নটেবলে রেকর্ড চাপিয়ে দিল। দাগ-এর শের নিয়ে বেগম আখতারের গজল
উজর আনে মেঁ ভি হ্যায়
অউর বুলাতে ভি নেহিঁ।
ওয়ায়েসে তারিকে
মুলাকাত বতাতে ভি নেহিঁ।
খুব পরদা হ্যায় কে
চিলমন সে লাগে বৈঠে
সাফ ছুপতে ভি নেহিঁ
সামনে আতে ভি নেহিঁ।
বেগম একটা একটা করে সুর লাগান আর ইবাদত ‘হায়! হায়!’ করে কপালে একটা চাপড় মেরে বলে—আরে, এই তো তিলক কামোদে লাওনর শকল। এই তো সেই ব্যথার মুখ, বুকের ধড়কন।
তারপর আস্তে আস্তে সুর ভুলে কথার চক্করে পড়ে ইবাদত। ৭৮-অর পি এম পুরো ঘুরে যেতে ফের নতুন করে চালায়। বিশ-বাইশ বারের পর নিজের সঙ্গে কথা শুরু হয় ইবাদতের—সালাম দাগ দেহলভি সাহাব! তুমি কোথায় পেয়েছিলে আমাকে অতকাল আগে? এত দুঃখ তো শুধু আমারই আছে সাহেব, তুমি কোথায় পেলে সেসব?
কী সুন্দর বলছ তুমি দাগ, যেন আমিই বলছি। চিয়ার্স টু ইউ, মাস্টার! বলে এবার গেলাসের স্কচটা শূন্যে তুলে ধরল ইবাদত।
তারপর জানলার বাইরের অন্ধকার আরব সাগরের দিকে চোখ মেলে বলল, ঠিকই ধরেছ, দাগ। না আসার হরেক ওজর দেখায় সে, অথচ আমাকেও ডাকে না। বলে না কবে দেখা হবে, তাও। এমন করে সে নিজেকে ঢেকে রাখে চিকের আড়ালে, যে দেখাই পাই না। পুরো লুকোয় না, আবার স্পষ্ট করে ধরাও দেয় না। সত্তর বার রেকর্ডটা বাজিয়ে আর দুটো করে বরফ দিয়ে এগারো পেগ হুইস্কি খেয়ে ইবাদত বেহুশ হয়ে পড়ে গিয়েছিল ঘরে। দরজায় টোকা মেরে সাতবার ফিরে গিয়েছিলেন আম্মা অঞ্জুমান বেগম। ছেলে ‘আসুন!’ না বললে দরজা ঠেলে ডোকা আদত নয় ওঁর। কিন্তু ভোর রাতে আর না এসে পারেননি।