তারপরই ওঁর ওই দিলখোলা ‘হাঃ হাঃ হাসিতে কেঁপে উঠেছিল নদীর পাড়।
রবীন্দ্র সদনের ফয়ারে নরম করে বাজছিল খাঁ সাহেবের সেই সব দরবারির কোনো একটা। মানুষের ঢল নেমেছে সদনের চত্বরে, অদূরে আঁচলে চোখের জল মুছছে দু-টি বাঙালি মেয়ে, এক বৃদ্ধ মোল্লা আকাশের দিকে চেয়ে কীসব বলে যাচ্ছেন আপন মনে, আর সুমন্তর শুধু মনে পড়ছে নদীর পাড়ে ঘাটের সিঁড়িতে বসা খাঁ সাহেবকে।
তুমি জানো, বাবুসাহেব, আমি আম্মা অঞ্জুমান আরা সাহেবানের আদেশে গান গাওয়া ছেড়েছিলাম!—এক সুদূর কণ্ঠে বললেন ইবাদত হুসেন খান। উনি কোনো জবাব চাইছিলেন কিনা না বুঝতে পেরে সুমন্ত বলেছিল, তাই তো শুনেছি।
ঝাঁ করে শিল্পী বললেন, কোথায় শুনেছ? আমতা আমতা করে সুমন্ত বলল, হয়তো পড়েছি কোথাও।
অল রাবিশ! যত নিউজপেপার ফিকশন। নাও ইউ হিয়ার ফ্রম মি… বাট!
বাট?
আমার কহানি কোনো ইন্টারভিউ করে লিখবে না।
বুঝলাম না জনাব।
ইবাদত হুসেন খান হাতের সিগারেটটা নদীর জলে ছুড়ে ফেলতে ফেলতে বললেন, রাইট ইট লাইক স্টোরি, লাইক হিস্ট্রি, যেমন কিনা ‘সাউণ্ড অব মিউজিক’ সিনেমা, যেখানে হাসি থাকবে, কান্না থাকবে, গানও থাকবে, অ্যাণ্ড ইট উইল অলসো বি আ ভেরি টু স্টোরি অব লাইফ। শুধু একটা নাম তুমি সেখানে ইউজ করতে পারবে না…কার নাম, সাহেব?–জিজ্ঞেস করে বসেছিল সুমন্ত।
খাঁ সাহেব বললেন, তার নাম, যাকে নিয়ে কহানি।
প্রমাদ গুনল সুমন্ত, সে কী! যাকে নিয়ে গল্প তারই নাম করা যাবে না! দেন হাউ উইল ইট বি টু?
ইবাদত খাঁ আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, বিকজ আই অ্যাম টেলিং দ্য স্টোরি। আর নামে কী এসে যায়? করে দাও লায়লা কি মুমতাজ কি রিজিয়া…
সুমন্ত বলল, তা হলে আপনার জীবনের সেই একটাই চাঁদ মেঘেই ঢাকা থেকে যাবে!
ইবাদত খাঁ বললেন, না, থাকবে না। দুনিয়ার যেখানেই আমার ইন্তেকাল হোক, সেই নাম তোমার কাছে পৌঁছে যাবে। আর জানো তো বাবু, আমার সময় বেশি নেই। একেক দিন শুতে গেলে মনে হয় সব তো পাব না। কে জানে কালকের সকালও দেখতে পাব কি না!
খাঁ সাহেবের কথায় শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে গেল সুমন্তর। খাঁ সাহেব বললেন—তোমার কহানিতে আমার সেই পুনমকে চাঁদের নাম যা খুশি রাখো, কিন্তু দেখো ওর গায়ে যেন কলঙ্ক না লাগে।
সুমন্ত বলল, কলঙ্ক তো চাঁদেরই হয়, জনাব। যাতে আরও সুন্দর হয় চাঁদ।
এবার উপরে আকাশের দিকে চোখ মেলে সরু একফালি বিবর্ণ চাঁদ দেখতে দেখতে ইবাদত খাঁ বললেন, জানি। আর এও কি জানি না, ইতিহাস লেখা হলেও ইতিহাস থেকে যায়? আর তা মানুষ জেনেও যায়। যে-জন্যই কিনা হিন্দোস্তানের এক সেরা শায়ের লিখেছিলেন সেই কত কত বছর আগে
পত্তা পত্তা বুটা বুটা
হাল হমারা জানে হ্যায়।
জানে ন জানে গুলহি ন জানে
বাগ তো সারা জানে হ্যায়।
বুঝলে কিছু? কবি বলছেন, পাতায় পাতায়, কুঁড়িতে কুঁড়িতে আমার অবস্থা জানাজানি হয়ে গেছে। ফুল জানুক বা না জানুক, বাগিচা সব জানে।
তারপর কী একটা সুর ভাঁজতে শুরু করেছিলেন খাঁ সাহেব, আর তারই মধ্যে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নাও, চলো। আমার বলতে ইচ্ছে করছে…। তারপর আর সেই রাতের কিছু মনে নেই সুমন্তর। কিছু লেখেনি, কিছু টেপে রেকর্ড করেনি, শুধু শুনেছে…কখন চাঁদ আর সঙ্গী তারারা মিলিয়ে গেছে ভোরের আলোয় জানতেও পারেনি। কথা শেষ করে কখন উস্তাদ ওরই কোলে কাশতে কাশতে ঘুমিয়ে পড়েছেন…বেচারি হানিফ এসে ভয়ে ভয়ে ডেকেছে, সাব! খাঁ সাব! সুবহ হো রহা, ম্যাঁয় চায় লাউ?
সেদিন সন্ধ্যায় খাঁ সাহেবকে নার্সিংহোমে ভর্তি করে এল সবাই। তার তিন দিন পর নিয়ে যাওয়া হল মুম্বাইয়ের যশলোক হসপিটালে। বলা হল ফুসফুঁসে ক্যান্সার। এও শোনা গেল সময় মতো ধরা পড়ায় পরমায়ু হয়তো বছর খানেক বাড়ল। তারপর দু-মাস না যেতেই …
খাঁ সাহেবের বডি ফের কাঁধে তুলেছে সবাই, এবার যাত্রা শুরু কবরের দিকে। হাতের পান্ডুলিপিটা বুকের কাছে ধরে স্থির হয়ে সেই এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সুমন্ত সকাল থেকে। খবরের কাগজে জন্নত শব্দটা নিয়ে চর্চার কথা পড়ে গল্পের সাবখান থেকে জরিনা নামটা কেটে কেটে জন্নত করেছে। কারণ? ওর মন বলছে শেষ চিরকুটে নামটা লিখেছিলেন খাঁ সাহেব মেঘ সরিয়ে বুকের চাঁদটাকে একবার বারে আনতে। শেষনিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে চাঁদটাকেও মুক্তি দিয়েছিলেন…
২.
হাই কমিশনার কৃষ্ণ মেনন সাহেব ফাইল থেকে মুখ না তুলেই বললেন, দেশে ফেরার জাহাজ টিকিট চাইতে এলে তো, ইবাদত? ওটা এখন পাবে না। কিপ প্লেইং অ্যাণ্ড এনজয় ইংল্যাণ্ড।
সুদর্শন তরুণ সেতারি উস্তাদ ইবাদত হুসেন খান হাই কমিশনারের মস্ত টেবিলের সামনের একটা চেয়ারে আস্তে করে বসতে বসতে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, কিন্তু আমার মনটা বড়ো খারাপ হয়ে আছে, স্যর।
এবার চোখ তুললেন কৃষ্ণ মেনন—হোয়াই?
আবার গলা ধরে যেতে বসল ইবাদতের, আজ্ঞে, মন খারাপের কি কোনো ‘কেন’ আছে স্যর?
কৃষ্ণ মেনন বেল প্রেস করে দু-কাপ চা আর কিছু বিস্কুট অর্ডার করলেন। তারপর হঠাৎ ফেটে পড়লেন—আই ডোন্ট আণ্ডারস্ট্যাণ্ড ইউ আর্টিস্টস! টাকা, যশ, আরাম, ফুর্তি সব পাচ্ছ এখানে, আর তার পরেও ইউ স্টিল ওয়ান্ট টু গো হোম। কী আছে দেশে বলো তো আমায়।