জীবনে তো অনেক কিছুই আসে, হয়, ঘটে, কিন্তু তার মানেই কি তা পাওয়া যায়? জীবনে কম তো সিতার বাজাইনি, তা বলে কি ভৈরবের ঋষভটা একবারও আব্বা ইজাজাত খাঁ সাহেবের মতো টানতে পেরেছি?
সুমন্ত ইবাদত খানের প্রশ্নের উত্তরের চেষ্টা না করে বলেছিল, কিন্তু আপনার তিলক কামোদ রেণ্ডারিং পৃথিবীকে আপনার প্রেমের কথাই শোনায়। প্রেমে না পড়লে তিলক কামোদের ওই চেহারা কি আসে, খাঁ সাহেব? আই মিন নারী-পুরুষের প্রেম।
সরলভাবে হেসে খাঁ সাহেব বলেছিলেন, আসে না বুঝি? সুমন্ত কথার জবাব দিচ্ছে না দেখে ফের বলেছিলেন, তুমি ঠিকই ভেবেছ—আসে না। চাঁদ না দেখলে চাঁদের বর্ণনা দেওয়া যায় না। তবে চাঁদ দেখা গেলেই কি চাঁদকে পাওয়া হয়, বাবু?
প্রেম তা হলে এতই দূর?—জিজ্ঞেস না করে পারেনি সুমন্ত।
খাঁ সাহেব তখন স্বগতোক্তির মতোই বলেছিলেন, সবই নির্ভর করে জীবনের এত নারী, এত সম্পর্কের মধ্যে ঠিক কোনটিকে তুমি সেই একটা প্রেম, একটা চাঁদ, সেই ভৈরবের ঋষভ বলে ধরতে চেয়েছ, কিন্তু পারেনি। একটা স্বর্গ … একটা জন্নতও বলতে পারে, যার খবর তোমার আছে, কিন্তু তুমি গিয়ে পৌঁছাতে পারলে না।
ইবাদত হুসেন খান এরপর নীচু হয়ে মাটির থেকে কাগজের টুকরোগুলো যত্ন করে কুড়িয়ে পাশের ছোট্ট টেবিলে রাখতে রাখতে বলেছিলেন, এই যে সব নারীর কথা লিখেছ, এদের সবার কথা আমিই বলেছি…ঠিক কথা। কিন্তু বলতে যে পারলাম তা তো ওই জন্যই কি এরা সব একেকটা ঘটনা আমার জীবনে। কিন্তু এই সব কহানির মধ্যে ওই যে একটা প্রেম কোথায় হারিয়ে গেল তা কি আর তুমি জানতে পারলে? না তোমার রিডার কোনোদিন জানতে পারবে? তোমরা আমার তিলক কামোদের রোমান্টিসিজমটাই দেখতে পাও, তার পিছনের দর্দ-এ-দিল, বুকের রক্ত দেখতে পাও? তোমার এই ইনটারভিউয়ে আমার মুহববত বলে অনেক মিঠি বাত, মিঠি বোলি, মিঠা দর্দের কথা লিখেছ, পড়তে বেশ মজাও আসছে…বাট ইজ দ্যাট মাই লাভ? যা কিনা আমি পঞ্চাশ বছর ধরে এই ভাঙা বুকটায় এই এইরকম করে লুকিয়ে আসছি?
ইবাদত খাঁ এমন করে দু-হাতে বুকটাকে আগলে ধরলেন যেন সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকে বুকে নিয়েছেন। সুমন্ত জিজ্ঞেস করল, এই পঞ্চাশ বছর ধরে ব্যথাটা বুকে ধরে রেখেছেন কোনোদিন কাউকে বলবেন না বলেই কি?
অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছিল, নদীর পাশের বাড়ির ছাদে আরামকেদারায় বসা খাঁ সাহেবকে এক রাশ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছিল না। কিন্তু ওঁর কণ্ঠস্বর ভেসে এল—বলব কী করে বাবুসাহেব? বাজনাতেই পুরো ঢালতে পারি না। একটা সিগারেট ধরিয়ে কেদারা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ইবাদত খাঁ, একটা লম্বা টান দিলেন সিগারেটে, তারপর আস্তে করে হেঁটে গিয়ে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার সেই চাঁদ, সেই প্রেম নিয়ে বলতে গেলে রাধার দশা হবে। যাকে সখীরা প্রশ্ন করছে, হ্যাঁ রে, তোর কৃষ্ণকে দেখতে কেমন? আর সে বলছে, কী করে বলি বল? যে জুবান বলবে তার তো আঁখ নেই, আর যে আঁখ দেখে তার তো জুবান নেই।
খাঁ সাহেব হাসছিলেন, কিন্তু অন্ধকারে ওই হালকা হাসিটাও বড়ো করুণ শোনাচ্ছিল সুমন্তর কাছে। হাসি মিলিয়ে যেতে কাঁপা কাঁপা গলায় সুমন্ত বলেছিল—আমি খুব সাধারণ একজন সাংবাদিক, খাঁ সাহেব। আপনি কি চাইবেন না আপনার এই লুকোনো, না বলা প্রেমের কাহিনি লিখে একটু সমাদর পাই মানুষের? একটু নজর…?
ফের এক রাশ নৈঃশব্দ্য নেমেছিল নদীর পাড়ের খোলা ছাদে। একটা ঝিরঝির বাতাসও উড়ে এসেছিল কোত্থেকে। ঘন কালোর মধ্যে টেবিলে রাখা ছেঁড়া পান্ডুলিপির সাদা কাগজগুলো একটু বেশি রকম সাদা ঠেকছিল, রাতের সমুদ্রতটে ঢেউয়ের সাদা ফেনার মতো। সুমন্তর গলায় একটা চাপ তৈরি হচ্ছিল চাপা কান্নার। ওর মনে হল, খাঁ সাহেবকে একটা প্রণাম করে বাড়ি ফিরে যায়। বোধ হয় উঠতেই যাচ্ছিল সুমন্ত, হঠাৎ পিঠে ভারী দুটো হাত ইবাদত হুসেন খাঁর, আর স্নেহ ঝরে পড়া গলায় আদেশ-বোসো!
সুমন্ত তো তখনও বসে, পিছন ফিরে উপরে চেয়ে বলল, কিছু বলবেন, সাহেব?
খাঁ সাহেবের কণ্ঠ ভেসে এল, কত অবধি রাত জাগতে পারো, বাবু? কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সুমন্ত বলল, কেন, সাহেব?
খাঁ সাহেবের কথা ভেসে এল ফের, কেন, আমার প্রেমকহানি শুনবে যে!
সুমন্ত বলল, তা হলে সারা রাত!
‘তাহলে এসো’ বলে ইবাদত হুসেন খাঁ ওর হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন বাড়ির সদর দরজায়, বাবুর্চি হানিফকে হাঁক দিয়ে ডাকলেন। সে ‘জি হুজুর! জি হুজুর’! করে দৌড়ে আসতে বললেন, দশ বাজে করিব খানা লগানা সাহাবকে লিয়ে। মেরে লিয়ে বস এক স্যুপ। হম অব বৈঠেঙ্গে নদী কে কিনারে…প্রমাদ গুনেছিল হানিফ। বাইপাস হওয়া অসুস্থ শরীরে নদীর পাড়ে খাঁ সাহেব? সে শিউরে উঠে বলল, সাব, ইস ওয়ক্ত! খাঁ সাহেব শুধু গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন, হানিফ! হানিফ চুপ মেরে গিয়েছিল তৎক্ষণাৎ, খাঁ সাহেব গায়ের হালকা চাদরটা জড়িয়ে নিতে নিতে বলেছিলেন, এরা জানেই না আমি কবেই মরে গেছি, এরা সি একটা লাশকে পাহারা দিচ্ছে। খাঁ সাহেবের পাশে হাঁটতে হাঁটতে সুমন্ত অনুযোগ করেছিল, কেন এমন অলক্ষুণে কথা বলেন, সাহেব?
ওর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে ইবাদত হুসেন খাঁ বলেছিলেন, বাবুসাহেব, যতবার আমি দরবারি ধরি ততবারই আমি মরি…তুমি জানো না?