ইবাদত খান তখন ফ্যালফ্যাল করে উপরে ধবধবে সাদা সিলিঙের দিকে চেয়ে, আর সেই চোখে তখন দু-ফোঁটা জলও কি ছিল না? বেডের পাশ থেকে সরে আসতে আসতে ডা. শেঠনা নার্স মেরি জনকে বলেছিলেন, আই ডোন্ট নো হোয়াই খান সাহাব ইজ ভেরি স্যাড টুডে। মেরি জন লক্ষ করেছিলেন খাঁ সাহেবের ডান হাতের তর্জনীর কাঁপুনি। সেদিকে দৃষ্টি রেখে ডা. শেঠনার উদ্দেশ্যে বললেন, ইজন্ট হি ট্রাইং টু রাইট সামথিং, ডক্টর?
ডা. শেঠনা মাথা ঘুরিয়ে দৃশ্যটা দেখে বললেন, অর ইজ হি ট্রাইং টু প্লে সামথিং? দ্যাটস হিজ সিতার ফিঙ্গার, ইজন্ট ইট?
ইবাদত খাঁর চোখ বুজে এসেছিল ততক্ষণে, বন্ধ চোখের পাতা চুইয়ে দু-ফোঁটা জল বেরিয়ে এসে চোখের দু-পাশে গড়াল। ডাক্তার চলে যেতে মেরি জন শিল্পীর মাথার কাছে মুখ নিয়ে কোমল করে বললেন, সাহেব, কিছু বলবেন?
ইবাদত খাঁ চোখ বোজা অবস্থায় বিড়বিড় করলেন কিছু, কিন্তু সে-কথায় ধ্বনি নেই। মেরি জনের চোখ ফের চলে গিয়েছিল শিল্পীর ডান হাতের আঙুলটার দিকে। ফের কী একটা লিখছে যেন ওই তর্জনী। মেরি জন নরম করে জিজ্ঞেস করলেন, কলম দেব? কিন্তু খাঁ সাহেব কি তা শুনতে পেলেন?
মেরি জন তখন একটা হালকা কলম এনে শিল্পীর হাতে দিলেন আর তার নিবের নীচে একটা ছোট্ট প্যাড ধরে বসলেন।
এতক্ষণের সচল তর্জনী এবার স্থির হয়ে গেল। মেরি জন দেখলেন খাঁ সাহেবের ঠোঁট নাড়াও বন্ধ।
সেদিন মধ্যরাতে উস্তাদ ইবাদত হুসেন খান দুনিয়ার সব মায়া কাটিয়ে জন্নতের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন, কিন্তু দম তোড়ার আগে একটাই কথা উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন—
কলকাত্তা যানা হ্যায়। আর মেরি জনের হাতে ধরা প্যাডে প্রায় হিজিবিজি করে আঁকতে পেরেছিলেন একটাই শব্দ উর্দুতে—জন্নত।
প্লেনে করে ওঁর মরদেহ কলকাতায় আনতে আনতে চর্চা চালু হয়েছিল খাঁ সাহেব কলকাতাকেই কেন জন্নত মেনেছিলেন। ওঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী মির বখশ সাহেব বললেন, আরে বলবে না-ই বা কেন? এই কলকাতাতেই কি গোর হয়নি ওর আব্বা মরহুম উস্তাদ ইজাজত হুসেন খাঁ সাহেবের!
উস্তাদের নামটা করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কানে আলতো করে আঙুল ছোঁয়ালেন মির বখশ।
মির বখশের পাশের সিটে ছিলেন ইবাদত খাঁর নামজাদা হিন্দু শিষ্য, মুম্বাইয়ের ব্যাবসাদার অরুণ পোপট। তিনি বললেন, পরন্তু মি সাহাব, উস্তাদজি কিন্তু তালিম দিতে দিতে কখনো কখনো বলেছেন, ‘জন্নত হ্যায় কি নহি মুঝে পতা নহি। মগর সিতার বজাতে হুয়ে জিন্দেগির্মে কই দফে এহসাস হুয়া কে ম্যাঁয় জন্নতমে হু। ওঁর জন্নত, মির সাব, কলকাতায় বললে সেতারকে একটু হেলাফেলাই করা হবে।
মির বখশ এমনিতেই কম কথার মানুষ, তিনি আর কথা বাড়াননি।
কিন্তু খাঁ সাহেবের দেহ দমদম থেকে ওঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে যেতে ওঁর শেষ হস্তাক্ষরটি কোথায় যে তলিয়ে গেল, কেউ আর তা মনে করতে পারল না। তাঁর দুই বিবি ও তাঁদের পুত্র-কন্যাদের মধ্যে একটা অনুচ্চার দ্বন্দ্বই শুরু হয়ে গিয়েছিল বডি কোন বাড়িতে প্রথম যাবে তা নিয়ে, কিন্তু মৃত্যুর মুহূর্তেও ডান হাতের মুঠোয় ধরা চিরকুটটা নিয়ে কারোই কোনো তাপ-উত্তাপ নজরে পড়ল না।
তবে চিরকুটের ওই ‘জন্নত’ শব্দটা নিয়ে চর্চার ইতি হল না। খবরের কাগজের প্রতিবেদনেও কথাটার উল্লেখ হল। প্লেনে বসে মির বখশ ও অরুণ পোপটের দু-দুটো ব্যাখ্যাও রসিয়ে লেখা হল কোনো এক পত্রে। রবীন্দ্র সদনে ফুলমালায় ঢাকা খাঁ সাহেবের শবের পাশ দিয়ে একে একে হেঁটে যাচ্ছেন মন্ত্রী আমলা লেখক শিল্পী সংগীতজ্ঞরা যখন, দূরে এক কোণে দাঁড়িয়ে সুমন্ত তখন মনের চোখে বহুদিন আগের সেই সন্ধ্যার দৃশ্যটা দেখছিল। খাঁ সাহেব অদ্ভুত এক ছন্দে একটু একটু করে ছিড়ছেন ওর লেখা খাঁ সাহেবের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের পান্ডুলিপিটা। আর আপন মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছেন, আমি ইতিহাসে থাকতে চাই, সুমন্তবাবু, নিউজপেপারের হেডলাইনে নয়।
সস্নেহে ‘বাবু’ করে ডাকার আদত ছিল খাঁ সাহেবের, অথচ ওই স্নেহের ভাষাতেই জগতের সবচেয়ে কঠিন কথাটাও বলে ফেলতে পারতেন। সেই সন্ধ্যায় যেমন পান্ডুলিপিটা ছিড়তে ছিড়তে বললেন, এত কিছু বললাম তোমাকে আমার সিতার আর জিন্দেগি নিয়ে, তবু তোমাকে লিখতেই হল আমার পেয়ার-মোহব্বত নিয়ে? কিছু নারীর সঙ্গে কতটুকু কী ঘটল তাকেই প্রেম আর ভালোবাসা বলছ, আর সেতারের প্রতি সারা জিন্দেগির এই রিয়াজত, ডিভোশন, তার কোনো দাম নেই?
সুমন্ত তখন খুব নীচু গলায়, কিন্তু স্পষ্ট করেই বলেছিল, কিন্তু সেতার ধরেও আপনি প্রেম আর ভালোবাসাই খুঁজেছেন চিরকাল …আপনি নিজেই বলেছেন।
সন্ধ্যার অন্ধকারে খাঁ সাহেবের মুখ বেশ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল, নীলচে কালো আকাশ আর নদীর পশ্চাদপটে একটা সিলুয়েটের মতো ধরা দিচ্ছিল মুখটা। প্রশ্ন শুনে ওঁর মুখের কী ভাব হল সুমন্ত দেখতে পেল না, কিন্তু মুখের সরল জবাবটা শুনে বেবাক অবাক হয়ে গেল। খাঁ সাহেব বললেন, হ্যাঁ, প্রেম তো আমি খুঁজেছি, সারাক্ষণ খুঁজেছি…কিন্তু পেয়েছি কি? পেলে, এই দু-হাতে জড়িয়ে রেখে দিতাম বরাবরের মতন, যেমন করে ধরে রেখেছি সিতারকে। সুমন্ত চুপ করে ছিল, মাথার মধ্যে খেলাচ্ছিল কী করে এইমাত্র টুকরো টুকরো হওয়া সাক্ষাৎকারটাকে নতুন করে লিখবে। লিখলে তাতে এইমাত্র শোনা কথাগুলোও কীভাবে কোথায় জুড়বে। ওকে চুপ দেখে কিংবা নিজের কথাতেই একটু অবাক হয়ে খাঁ সাহেবও চুপ করে গিয়েছিলেন। দু-জনের মধ্যে একটা মাছির ভনভনানি ছাড়া কোনো শব্দ ছিল না। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে খাঁ সাহেব বলে উঠেছিলেন, পেয়ার হয়নি এত বদনসিব আমি নই, সুমন্তবাবু। কিন্তু পেয়ার হওয়া মানেই কি পেয়ার পাওয়া?