শুভেন্দু বলল, না।
—কিছুই মনে হয়নি?
—হ্যাঁ, একটা ভয় ছিল। মা-র স্মৃতি হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে। পুরোনো কথা ছাড়া বিশেষ কিছুই মনে থাকত না। ক-বছর আগের দেশবিভাগও মা ভুলে গিয়েছিলেন। আর…
উদগ্রীব হয়ে বলে বসলাম, আর?
-হঠাৎ একদিন বলেছিলেন, আমি খুলনায় নেই দেখে চুনে যেন ও বাড়ি বেচে না দেয়। ভেতরে ভেতরে একটা জ্বালা হচ্ছিল, কিন্তু বাইরে তার আভাসটুকু না দিয়ে বললাম, তখন তুমি কী বললে?
শুভেন্দু মাটিতে ওর হাতের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, আমি বললাম চুনেদা চাইলেও এখন আর তা সম্ভব নয়। ওটা তো ফরেনার্স প্রপার্টি। বিদেশির সম্পত্তি। আর তা শুনে মা কেঁদে ফেলে বললেন, তাহলে আমি কোথায় ফিরব শুভ?
অন্ধকার আকাশে বিদ্যুল্লেখার মতো ঝলসে উঠল শুভেন্দুর মুখে মা-র এই কথাগুলো। আকাশপাতাল হাতড়াতে লাগলাম আমি। কলকাতায় আজ আমার এত বড়ো বাড়ি, দেশে অত বড়ো পাথর-বাঁধানো দালান, অথচ মা-র একটা মাথা গোঁজার জায়গা হচ্ছিল না! এই এক চিলতে বারান্দায় বন্দি থাকল মা পাঁচ-পাঁচটা বছর। তাও রাস্তা ভুলে…
আমার আর চিন্তাও আসছিল না। মা এই বারান্দা থেকে মুক্তি পাবে বলে… আমি রেলিঙে ঝুঁকে নীচে রাস্তা দেখলাম। আর একটা ঘোর ধরে গেল মাথায়। চর্কির মতো মগজটা ঘুরছে মাথার ভেতর। মনে হচ্ছে আমিই যেন ধাক্কা মেরে মা-কে ফেলেছি এখান থেকে। আমি দু তালুতে রেলিঙে মাথা চেপে ধরে বললাম, কিন্তু তোমরা কী বিবেচনায় মা-র সংবাদ আমাকে দিলে না, শুভেন্দু?
ও বলল, রানি ছাড়া তোমার সব বোনেরই ধারণা ছিল তুমি পাষন্ড। তুমি তিলে তিলে মা কে হত্যা করেছ। ইট ইজ নট আ সুইসাইড, বাট মার্ডার।
-আর রানি কী ভাবে?
—ও ভাবত তোমরা দু-জনাই দু-জনার মৃত্যুর জন্য দায়ী হবে। আমি ওর কাছেই জেনেছি তুমি কিছুদিন আগে সেকেণ্ড অ্যাটাক সার্ভাইভ করেছ।
হে ভগবান, এই দ্বিতীয় স্ট্রোক থেকে কি আমার না বাঁচলেই চলত না। আজকের এই গ্লানি তো আমার সব আলো নিভিয়ে দিচ্ছে। আমি ডান হাতটা আলতো করে, বুকের বাঁ দিকে বোলালাম। বললাম, তোমরা জামাইরা কী ভাবতে আমার বিষয়ে?
শুভেন্দু কাছে এসে হাত ধরে আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল। আর বলল, অন্যদের চোখে তুমি কিছুটা দেবতা, কিছুটা অমানুষ, কিন্তু মানুষ নও।
—আর তোমার চোখে?
-আমার কোনো চোখ নেই, চুনেদা। আমি চিরকাল তোমাকে মা আর রানির চোখে দেখেছি।
–তার মানে?
–কোনো মানে নেই, চুনেদা। কোনো মানে নেই। এসব দেখার কোনো মানে হয় না।
শুভেন্দু কাঁদছে। নিঃশব্দে। ও আমার কান্নাটা কাঁদছে, আমার তো চোখে কখনো জল আসে না। আমি নিষ্পলক ওকে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলাম, ওদের কথা ছাড়ো। তুমিও তো আমায় খবর দিতে পারতে, শুভেন্দু।
গায়ের চাদরে চোখ মুছতে মুছতে শুভেন্দু বলল, আমি কেন বলব? আমিই তো তোমাকে খবর দিতে নিষেধ করেছিলাম।
আমার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। শুভেন্দু বারণ করেছিল আমায় খবর দিতে… শুভেন্দু। দিস স্কাউন্ড্রেল অফ আ জেন্টলম্যান! আমি ঘৃণায়, অবিশ্বাসে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম—তুমি বারণ করেছিলে!
শুভেন্দু শান্ত গলায় বলল, মা-র মুখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, চোখ বলে কিছুই ছিল না, ঠোঁটও ছিল না। মায়ের মুখের কিছুই দেখতে পেতে না তুমি, চুনেদা। ওই দেখাকে শেষদেখা বলা যায় না, ওই মুখাগ্নির জন্য ডেকে তোমাকে আমি অপমানিত হতে দিইনি। মুখাগ্নি আমিই করেছি।
আমার মনে হচ্ছে বুঝিবা সূর্যগ্রহণ হয়ে আকাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। মা-র আসনে বসে আমি গ্রহতারকা দেখছি। বারান্দাটা শূন্যে ভাসছে, একটু শরীর হেলালে আমি বাইরে ভেসে যাব। আমি বুঝতে পারছি শুভেন্দু হাত ধরে আমায় তুলছে, আমি কৃতজ্ঞচিত্তে ওকে ধন্যবাদ দিচ্ছি, রানি শুভেন্দুকে বকছে এতসব কাহিনি শোনানোর জন্য। আমি কিছুটা ভদ্রস্থ হয়ে কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়ে শুভেন্দুকে বললাম, তোমরা আমার বাড়ি কোনো দিন যেয়ো না, শুভেন্দু। রানি তুইও যাবি না। দিদি জামাইবাবুদের বারণ করিস। জানবি তোদের দাদা নেই। আমি অনেক আগে থেকেই তোদের ত্যাগ করেছি। তোরা মাকে খুন করেছিস!
রানি কেঁদে উঠেছে, কী বলছ দাদা? মা চলে গেল, এখন তুমিও আমাকে ত্যাগ করলে!
আমি ওর পিঠে হাত রেখে বললাম, রানু, কাঁদবি না। আমাকে আর ক-টা বছর একলা থাকতে দে। আমাকে বর সাজানো হয়নি তোর, মারা গেলে প্লিজ আমার কপালে চন্দন দিয়ে তোর ওই সুন্দর হাতের লেখায় ‘মা গঙ্গা’ লিখে দিস। আমি আর বেশিদিন বাঁচব না রে, রানু। আর কটা দিন আমায় একলা থাকতে দে।
আমি সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছি, আস্তে আস্তে অ্যাঞ্জাইনা পেন-টাও ফিরে আসছে। ঊর্মির মুখটা চোখে ভাসছে, বড়ো অল্প বয়সে অনাথ হয়ে পড়বে মেয়েটা। ছেলেপুলেগুলোও বড্ড ছোটো। চলে যাওয়ার পক্ষে মোটেও ভালো সময় নয়। বেঁচে থাকার পক্ষেও। অনেক টাকা করতে হবে। কাউকে আমি ভাসিয়ে যাব না। এভাবে চলে গিয়ে মা সবাইকে ঊর্মির শত্রু করে গেছে। বেশ করেছে! ওদের কাউকে আমি চাই না। একলা থাকতে পারলে অনেক ভালো থাকব আমি, এটাই আমার প্রিয় জীবন। বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়ে মা ওদের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছে। মা এখন আমার, সম্পূর্ণ আমার। অসবর্ণ বিবাহের পুত্রবধূর পুজো নিতে মার আর কোনো অসুবিধা নেই। মা-র জন্য আমি ঊর্মিকে ছাড়িনি, এখন কারোর জন্য আমি মাকে ছাড়ব না। যে কটা দিন বাঁচি।
হায় চাঁদ!
তাঁর জীবনের শেষ দিনটায় মুম্বাইয়ের হাসপাতালের আই সি ইউ-তে বড় অস্থির ছিলেন সিতার নওয়াজ উস্তাদ ইবাদত হুসেন খান। বিড়বিড় করে কেবল কলকাতায় ফেরার কথা বলছিলেন, আর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বিছানার চাদরে কী একটা আঁকিবুকি কাটছিলেন। ডা: শেঠনা ওঁর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে আশ্বস্ত করেছিলেন, খাঁ সাহাব, আপ জরুর কলকাত্তা লওটেঙ্গে। বিলকুল শাহেনশা জ্যায়সা, অউর ঢের সারে গান-বাজানা ভি করেঙ্গে।