আমি মা-কে তুলে আনিনি কলকাতায়, দেশবিভাগের পর মা নিজেই চলে এল এখানে। কিন্তু আমার বাড়িতে নয়, রানির এই চৌখুপি ফ্ল্যাটে। মেয়ের সংসারে অতিথি হওয়ার গ্লানিও তুমি সহ্য করলে! অথচ কয়েকটা রাস্তা ওপারে আমার বাড়ির রাস্তা দিয়ে তুমি একটি বারও গেলে না। দেশের বাড়ির চার উঠোন জুড়ে তোমার চলাফেরা, গতিবিধি ছিল, আর এখানে এই এক চিলতে বারান্দায় বসে তুমি প্রহর গুনতে। আমার পাঠান শাড়ি, চাদর, শেমিজ তুমি যত্ন করে আলমারিতে তুলে রেখেছ, পরেছ জামাইয়ের কেনা কাপড়। আমার ছ-ছটি সন্তান হয়েছে, একটি মরেও গেছে, কিন্তু তুমি খবর নাওনি। দেশ আর কলকাতা মিলিয়ে চোদ্দোটা বছর তুমি আমার থেকে আলাদা থেকেছ, বামপন্থী সন্তানের মা দেশভাগের ন্যক্কারজনক ইতিহাসের সাক্ষী হয়েও থেকে গেছ কংগ্রেসি। শুভেন্দু খবর দিয়েছিল ইলেকশনেও তুমি আমার বিপক্ষে ভোট ফেলেছ। গত চোদ্দো বছরে তুমি আমার কোনো কিছুই গ্রহণ করনি, এমনকী আমার শ্রদ্ধাও। তিন বছর ধরে আমি হার্টের রুগি কিন্তু আমার অসুখের কথা তোমার কানে পৌঁছুতে দিইনি। সেটা খুব হৃদয়হীন কাজ হত আমার, কারণ আমার ব্যথাও তুমি নিতে না। পৃথিবীতে আমি ছাড়া কোনো কিছুরই মূল্য ছিল না তোমার কাছে, এমনকী আমার ভালোবাসা, ব্যথা-বেদনারও নয়। এখন দেখো, তোমার এই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি আমি, কিন্তু এই আমি তোমার সেই নিখাদ, বিশুদ্ধ সন্তান নই। আমি ঊর্মির স্বামী, পাঁচ সন্তানের পিতা, সফল উকিল, ব্যর্থ রাজনীতিক, ভিটেমাটিহীন এক শহুরে ভদ্রলোক। সাত-সাতটা বোনের বিয়ে দিয়েছেন এই ভদ্রলোক, আদালতে বহু মামলা জিতেছেন, বহু সম্পর্ক খুইয়েছেন এবং একমাত্র পুত্র হয়েও নিজের মায়ের মুখাগ্নি করার সুযোগ পাননি।
আমি ফের বারান্দায় গিয়ে মা-র ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসলাম। কৌটো খুলে একটা সিগারেট ধরালাম। দেখি রানি এক কাপ চা এনে পায়ের কাছে রেখেছে। ডেকে বলল, দাদা, তুই তো এখান থেকে কোর্টে যাবি। একটু চা খা। আমি উত্তর করলাম না। হঠাৎ শুনি শুভেন্দু বলছে, চুনেদা, সময় মতো খবর পেলে তুমি কি মুখাগ্নি করতে যেতে?
এরকম প্রশ্ন এক শুভেন্দুই করতে পারে, ভদ্রতাবোধে ও ক্রমশ কীরকম নির্বোধ হয়ে গেছে। ও কি কখনো মাকে জিজ্ঞেস করেছে, মা আপনি কি খুশি হবেন চুনেদা আপনার মুখাগ্নি করলে? নিশ্চয়ই করেনি, কারণ মা যে তলে তলে পাত্তাড়ি গোটানোর স্বপ্ন দেখছিল সেটাই তো ও আঁচ করতে পারেনি। হায় কপাল! পৃথিবীটা কি এই ধরনের অর্থহীন ভদ্রতার ওপরেই চলে?
যারা পুত্রকে মায়ের মৃত্যুসংবাদ পৌঁছে দিতে পারে না তারাই প্রশ্ন করে খবর পেলে ছেলে আসত কি না! মা এবং ছেলের মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান তা যে আসলে কী তা কি অঙ্ক কষে বার করতে হয়? আমি শুভেন্দুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ওকেই প্রশ্ন করলাম, আমি মুখাগ্নি করি মা তা চাইত?
শুভেন্দু ওর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রেলিঙে গিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল। আর বলল, তুমি তো রাতের আকাশ দেখো না চুনেদা, তুমি কী করে জানবে মা কী চাইতেন?
আমি বুঝতে পারছি শুভেন্দু ইচ্ছে করে, সুযোগ করে একটা শেল নিক্ষেপ করল। আমি একটু চুপ করে রইলাম, তারপর বললাম, তুমি জান মা আকাশের দিকে তাকিয়ে কী দেখত? শুভেন্দু মৃদু হেসে বলল, সম্ভবত কিছু না, তাকিয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করতেন।
–তার মানে!
—তোমার বোন বলতে পারবে কী বিড়বিড় করতেন। কিন্তু ওই সময়টুকুই ওঁকে সুখী দেখতাম আমি। একবার রাতের খাওয়ার জন্য ডাকতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তারা ছাড়া অন্য তারা কি নেই যা জায়গা বদলায় না?
—তাতে তুমি কী বললে?
–বললাম, কোনো তারাই স্থান বদল করে না। শুধু মানুষের দৃষ্টি বদলে যায়।
আমি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললাম, তুমি… তুমি শুভেন্দু তুমি ওই কথা বললে? কেন? কী জন্যে?
শুভেন্দু এগিয়ে এসে আমার হাতের পোড়া সিগারেটটা আঙুলে নিয়ে বারান্দার বাইরে ছুড়ে দিতে দিতে বলল, কারণ মা কোনো তারার চরিত্র জানতে চাননি আসলে। তিনি তোমার, আমার, রানির… মানে মানুষের কথা জানতে চাইছিলেন। আমার বা রানির কথাটা খুব বড়ো কথা নয়, হোয়াট ওয়জ ইম্পর্টান্ট ইজ ইউ। ইউ আর দ্য স্টার, দ্য পোল স্টার অর হোয়টএভার ইউ চুজ টু কল ইট। তুমি চিরকাল আমাকে ভদ্রলোক বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছ, কিন্তু আসল ভদ্রলোকটা তুমি। ইউ! তুমিই এতই উচ্চমনা ভদ্রলোক যে প্রতিপক্ষের পরাজয়ও তুমি মেনে নিতে পার না। মা তোমার কাছে যাননি কারণ ভেতরে ভেতরে তিনি তোমার কাছে হেরে গিয়েছিলেন। আর তুমি এতই মাতৃভক্ত ভদ্রলোক যে নিজে আসতে পারনি পাছে মা লজ্জা পায়, তাঁকে পরাজিত প্রমাণ করা হয়।
আমি শুভেন্দুর কথার প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেখলাম আমার গলা জড়িয়ে আসছে। শুভেন্দু হাত তুলে আমাকে থামার ইঙ্গিত করে বলল, আমাকে আরেকটু বলতে দাও চুনেদা। তোমার মতো পান্ডিত্য আমার নেই, আমি ফ্রয়েড-ইয়ুং জানি না, চিরকাল তোমার কথাই হাঁ করে গিলেছি। কিন্তু আজ আমাকে বলতে দাও প্লিজ।
আমি ইজি চেয়ার থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম, না, শুভেন্দু। আমি আজও তোমার কথা শোনার ধৈর্য ধরব না। বরং তুমি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। সত্যি, তুমি কি একেবারেই ভেবে উঠতে পারনি যে মা-র ভেতরে আত্মহত্যার চিন্তা ঢুকেছে?