ডরোথির কান্না শুরু হল। জল আসছিল অরুণের চোখেও। ও চোখের জল মোছার চেষ্টাও করল না। দু-জনে কোনো কথা বলল না বাকি সন্ধ্যে, নীরবে ধূমপান আর মদ্যপানে কেটে গেল সময়টা। ওঠার মুখে অনেক ভেবেচিন্তে একটা প্রশ্ন গুছিয়ে তুলতে পারল অরুণ। আচ্ছা, ডর, সুকের কাহিনি তাহলে কি ওর চলে যাওয়া দিয়েই শেষ হবে? গল্পটা খুব কষ্টের হবে তাহলে।
ডরোথি একটা ছোট্ট রিং হাওয়ায় ভাসাতে ভাসাতে বলল, কেন, গল্পের নায়িকা আমাকে দিয়েই তো শেষ হতে পারে। নায়কের স্মৃতি নিয়ে পড়ে আছে নায়িকা… কিংবা মারা যাচ্ছে!
এনাফ! বলে ধমকে উঠল অরুণ। ওভাবে কথা বললে আমি আর আসব না। ডরোথি ছেনালির হাসি হেসে বলল, তা কী করে হয়? আমাকে তো গল্পটা অনুবাদ করে শুনিয়ে যেতে হবে।
অরুণ গম্ভীরভাবে বলল, হুম! কিন্তু গল্পের তো শেষ দেখতে পাচ্ছি না।
ডরোথি বলল, পাবে, পাবে। মন দিয়ে শুরু করো। না হয় আবার আসবে।
তাই তো মনে হচ্ছে—বলে এক ঢোঁকে গেলাস শেষ করে উঠে দাঁড়াল অরুণ। শমির ব্যাপারটা হেঁটে দিয়ে বিপদ করেছ দেখছি।
কার বিপদ?—জিজ্ঞেস করল ডরোথি। তোমার না আমার?
দু-জনেরই-সংক্ষেপে জবাব দিল অরুণ।
কিছু না বলে নীরবে হাসল ডরোথি। অরুণ চলে যাচ্ছে দেখেও উঠে এল না দরজা অবধি। অরুণ খিল নামিয়ে দরজা খুলে ফেলেছে দেখে হঠাৎ বলে উঠল, অরু তুমি তো খুব পন্ডিত ছেলে, আমি তো কিছুই জানি না। তবে স্কুলে পড়া লর্ড টেনিসনের একটা কবিতার লাইন খুব মনে পড়ে। বলব?
অরুণ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, নিশ্চয়ই! বলো, আমি শুনছি।
ডরোথি চোখ বন্ধ করে লাইনগুলো মনে করার চেষ্টা করল।
মনে আসতে একটু গলা ঝাড়ল, তারপর স্কুলের এলোকিউশন কন্টেস্টের প্রতিযোগীদের। মতো প্রবল অনুভূতি দিয়ে বলতে লাগল
Out flew the web and floated wide;
The mirror crack’d from side to side;
‘The curse is come upon me,’ cried
The Lady of Shalott.
ওর আবৃত্তি শেষ হলে অরুণ ‘ব্রাভো!’ বলে আস্তে আস্তে হাততালি দিল। তাতেও ডরোথি চোখ মেলল না।
অরুণ ইশারায় বিন্দিয়াকে দরজা বন্ধ করতে বলে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে গেল।
৬.
অফিস থেকে ফিরে গা ধুয়ে, পোশাক বদলে, টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে ফের ডায়েরি নিয়ে বসল অরুণ। এবার প্রথম খন্ড। আর খুলেই এক মস্ত চমক…
প্রথম পাতাতেই বেশ বড়োসড়ো করে তারিখ লেখা—১লা এপ্রিল, ১৯৫-। তারপর হেডলাইনের মতো করে লেখা ‘অল ফুলজ ডে’। বোকাদের দিন। আর ডায়েরির প্রথম বাক্যটা আরও তাজ্জব-করা
তিন সপ্তাহ হল বাবা মারা গেছে, ফলে সংসারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় সম্পূর্ণ ছিন্ন হল। তবে বাবা বেঁচে থেকেও যে খুব একটা সম্পর্ক বর্তাচ্ছিল তাও না। যতদিন যাচ্ছিল বাবা ক্রমশ একটা দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়ে যাচ্ছিল। তাও এই লোকটার জন্যই আমি বম্বে ছেড়ে বেরোতে পারছিলাম না। কোথাও যাবার কথা উঠলেই বলত, দ্যাখ টোনি, আমরা আর্মেনিয়ান, তার ওপর ইণ্ডিয়াতে ফরেনার। এই বম্বেই আমাদের যথেষ্ট, অন্য কোথাও গিয়ে ঠাঁই পাব না।
আমি বলতাম, তা কি মরতে বম্বে এলে? সাইপ্রাসই তো ভালো ছিল।
তখন বলত, বাপ রে! কতগুলো মেয়েছেলে জুটে গেছল বল তো! তার মধ্যে তোর মা একটি।
আমি চুপ মেরে যেতাম। নাইটক্লাবের ম্যানেজার আমার পিতৃদেবটি যে-হারে মেয়েদের পেট বাঁধিয়ে যাচ্ছিল তাতে রাস্তাঘাটে ফুটফুটে ছেলেপুলে দেখলেই ভাই বলে ডাকার বাসনা হত। বলতে নেই, বাবার অজস্র আয়ের অনেকটাই খসে যেত মেয়েদের বাঁধানো পেট খালাস করতে। আজ যাবার স্মরণে এই ডায়েরি শুরু করতে এইসব কথা মাথায় ভিড় করে এল।
তবে আমার বাবা, আউগুস্ত সুক, সত্তর বছর বয়সে সদ্যমৃত (ঈশ্বর তার সহায় হন), খুব পাপী লোক ছিল না কিন্তু। ওর দোষ জীবনটাকে বড় ভালোবাসত, আর জীবন বলতে বেচারি বুঝত ওয়াইন অ্যাণ্ড উওমেন। মদ আর মেয়ের পিপাসা বাপটার মিটল না জীবনের শেষ দিন অবধি। বড়ো হওয়ার পর একটাই কথা শুনে এসেছি ওর মুখেইটস বেটার টু ডাই দ্যান নট টু বি এবল টু স্কু। সঙ্গম করতে না পারার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।
গত বছর গ্রান্ট লেন থেকে একটা ছুকরিকে তুলে বাড়ি আনছি দেড়া দাম দিয়ে..ফ্ল্যাটের সামনে এসে ছুকরি বলল, তুমি কি পিম্প?
আমি খচে গেছলাম, কী বলতে চাও, আমি দালাল?
ও তখন আমতা আমতা শুরু করল, না, মানে এখানে একটা খ্যাপা বুড়ো থাকে না?
বললাম, তাই বুঝি?
—তিন চার মাস আগে আমায় নিয়ে এসেছিল এখানে। অনেক টাকাও দিল। কিন্তু আমার বডি নিয়ে যা ছিনিমিনি করল জন্মেও ভুলব না।
কেন জানি না, লজ্জার বদলে খুব গর্বই হল বাবার এই ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটে। ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে খুলতে বললাম, বুড়োটা আজ নেই। জাহাজের পার্টিতে গেছে, কখন ফিরবে জানি না। তবে বুড়োটা আমার বাবা।
প্রচুর রাম খেলাম মেয়েটাকে নিয়ে, তারপর কী ঝোঁক চাপল কে জানে ফুর্তি করার সময় কেবলই জিজ্ঞেস করতে থাকলাম, বুড়ো আর কী করেছে? বুড়ো কী করল?
বাবা যা যা করেছে ঠিক সেই সেই কান্ড ঘটিয়ে যেতে যেতে এক জায়গায় এসে থমকে গেলাম। মেয়েটা বলল, বুড়ো এরপর আমার যোনিতে মাথা রেখে শীর্ষাসন করল। গুডনেস গ্রেশাস মি! সত্তর বছর বয়সের লোকটা এই সব করেছে! এই না হলে আমার বাপ!