রানি ছোটো বোন, আমাকে বোঝে। ও শুধু একটা শব্দ করেছিল—জানি!
সাত-সাতটা বোনের বিয়ে দিতে দিতে কবেই যে আমার যৌবন চলে গেছে জানতে পারিনি। শুধু রানির বিয়ের পাকা দেখার দিন ও হঠাৎ করে আমার কোঁকড়া চুলের সামনেটা থেকে একটা রুপোলি সুতোর মতো বার করে বলল, দাদা, শেষে তোরও চুল পেকে গেল!
আমি একটা বেতের মোড়ায় জবুথবু হয়ে বসেছিলাম। শেষে রানিও চলে যাবে, আমি আর মা একটা বড়ো দালান আঁকড়ে পড়ে থাকব। বুকটা ভার-ভার হচ্ছিল, কিন্তু নিজের জন্য কাঁদতে আমার একদম ভালো লাগে না। এত অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো ছেলেপুলে করে দেহরক্ষা করা কি খুব সমীচীন হয়েছিল পিতৃদেবের? জগতে সব দায়ই কি সংসারের বড়ো ছেলের? কিন্তু না, এসব কথা বাবাকে নিয়ে বলা যায় না। তিনি তো এক-শো বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুতে রেখেও গেলেন খুলনার বিষয়-আশয়, জমিদারি। চোখ বোজার আগে হাত ধরে বললেন, আমার কন্যাদের সৎপাত্রে দিয়ে। প্রয়োজনে বিষয় বিক্রি কোরো। শুধু এই ভিটেটুকু রেখো তোমার মা-র জন্য। আর…
না, আর কিছু বলা হয়নি বাবার। বরাবরই দেখেছি যে সবচেয়ে কঠিন প্রস্তাবগুলোই বাবা নীরবে রেখে যেতেন। আমি কিছু জমি বিক্রি করে বিলেতে আইন পড়তে যেত পারি কি না জিজ্ঞেস করতে বাবা নীরব ছিলেন। যার মানে ‘হ্যাঁ’-ও হতে পারে, আবার ‘না’-ও। আমার অবশ্য মনে হল বাবা আমাকে অতখানি চোখের আড়াল করতে সম্মত নন, তাই ওঁর উত্তর হিসেবে ‘না’-ই বেছে নিয়েছিলাম। সুতরাং বিলেতের আশা ছেড়ে কলকাতায় এসে কালো কোট পরে আদালতে যাওয়া আসা শুরু করলাম। কিছুদিন বাদে বাবা পত্র মারফত জানালেন, আমার আশীর্বাদ নিয়ো। আমি যতদিন জীবিত আছি এখানে টাকা পাঠাবার প্রয়োজন নেই। শুধু মনে রেখো, তোমার সাত-সাতটা বোন। আর তুমি আমার বড়ছেলে।
বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা হওয়ার মুহূর্তে প্রণাম সেরে রানি বলেছিল, দাদা, তুই বিয়ে করবি না? আমি অন্যমনস্কতার ভান করে বলেছিলাম, জানি না। সবই তো কপাল।
আমার একটু অভিমানও হল সবাই কীরকম আমাকে সহানুভূতির চোখে দেখে বলে। শুধু মা বাদে। কারণ একেকটা বোনের বিবাহের পর–র একেকটা বুক-চেরা দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনে আমার বুঝতে বাকি থাকত না যে, ওগুলো আর কারও নয়, আমার জন্য। আমি তখন খুব নাটকীয়ভাবে বলতাম, যাক, চার-চারটে পার হল। আর ক-টা হলেই স্বস্তি। আর মা তখন শাড়ির খুঁট দিয়ে চোখ টিপে ধরত, ভুলেও বলতে পারত না, চুনে, তোর সংসার করতে ইচ্ছে হয় না?
বলা যায় মা এবং রানিই একজোটে আমাকে নিঃসঙ্গ করে গেল। রানি বিয়ে হয়ে বাড়ি ছাড়ল, আর মা হুমকি দিয়ে গেল—এবাড়িতে একা থাকতে আমার দম বসে যায়। তুমি বউ না আনলে আমি খুলনা ছেড়ে এখানে এসে থাকতে পারব না। আমি ম্লান মুখে বলেছিলাম, আমার কি আর বিয়ের বয়স আছে মা? গত আশ্বিনে চল্লিশ পেরুলাম, আমার তো এখন একলা থাকতেই ভালো লাগে। মায়ে-ছেলেতে তো দিব্যি আছি। তুমি খুলনা যেতে চাও যাও, তবে পুত্রবধূর অপেক্ষায় থেকো না।
মা-র ফর্সা, সুন্দর মুখটা রাগে জ্বলছিল, ফরাশ থেকে নেমে চলে যেতে যেতে বলল, তোমার বাবা কখনো আমার মতামতের তোয়াক্কা করেননি। তুমিও করবে না, এ তো জানা।
মা কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরই আস্তে আস্তে বোপোদয় হল আমার; আমি বিয়ে করতে চাই না বলে নয়, পরলোকগত পিতা এবং মাকে একই সঙ্গে শাস্তি দিতে ভালো লাগে বলে। আমি চিরকুমার থাকলে ওঁদের বেশ হাস্যাস্পদ দেখায়। আমার মুহুরি রমেশ যেমন বলত, বড়দা আপনি সংসার না পাতলে বড়মার কিন্তু মরেও শান্তি নেই। অ্যাসিস্ট্যান্ট সৌরেন প্রশংসা করতে গিয়ে আমার রগের ব্যথা তুলে দিত, আপনার মতো পুত্র পেটে ধরা মহা ভাগ্য, বড়োবাবু! মাঝেমাঝে রানিও এসে অস্বস্তিতে ফেলত অবান্তর কিছু সংবাদ জুগিয়ে দাদা, মা চিঠিতে তোর কথা জানতে চেয়েছে। কী লিখব? আমি বলতাম, দেখতেই তো পাচ্ছিস। যা খুশি একটা লিখে দে।
রানি মুখ গোমড়া করে বসত কিছুক্ষণ, তারপর বলত, এতদূর এলাম শুধু এইটুকু জানতে? তাহলে লিখি, তুই ভালো নেই?
আমি আশকারা দেব না বলে বলতাম, সেটা মোটেই সত্যি কথা নয়। যাবার আগে রানি একবার না একবারটি বলতই, তুই বিয়ে করবি না দাদা? আমি অন্যমনস্কতার ভান করে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতাম। রানি বলত, তুই কোনোদিনও বদলাবি না, না?
কিন্তু যখন বদলালাম, মেয়ে পছন্দ করে মা-কে চিঠি দিলাম, লিখলাম যে পছন্দের মেয়েটি আমার প্রাণের সূর্য, এমনটি আমি জীবনে দেখিনি, আমি ভালোবাসায় ডুবে আছি, আমি সংসার করব, থিতু হতে চাই, শুধু একটু উদার হতে হবে মা-কে, মা চিঠিতে লিখল, আমি তোমার ভালোবাসায় অমর্যাদা করছি না চুনীলাল, তোমার পছন্দ কখনো আর কারও চেয়ে অক্ষম হবে না, কিন্তু অসবর্ণ বিবাহে আমি প্রাণ থাকতে মত দেব না। আমি মা হয়ে বলছি, তুমি এ বিয়ে কোরো না। যদি কর—তুমি বা তোমার বাবা কেউ কখনো আমার মত জানার মতো ধৈর্য রাখনি—তবে আমার মুখদর্শন কোরো না। আমার সমস্ত আশীর্বাদ রইল তোমার জন্য, কিন্তু তোমার হাতের মুখাগ্নির প্রত্যাশা আমি করব না।
এরকম কোনো চিঠির কোনো উত্তর হয় না, অথচ কী বোকামি! কী বোকামি! একটা উত্তর আমি কিন্তু লিখেও ফেলেছিলাম—মা, তোমার সুখ হবে বলে আমি বিয়ে করছি না, কিন্তু আমার নিজের সুখের জন্যও নয়। মেয়েটির আমি দ্বিগুণ বয়সি, তবু ওর বাড়ির লোক জানাচ্ছে, আমি বিয়ে করে ওকে উদ্ধারই করব। রূপ ছাড়া ওর আর কোনো যৌতুক নেই। বড়ো গরিব পরিবার। মা, আমি বিয়ে করছি ওই মেয়েটিকে সুখী করতে। ভালোবাসা ছাড়া ওর আর কিছুই দেবার মতো নেই বলেই ওকে এত ভালো লাগছে আমার। মধ্য বয়সেও কি আমার কুলের গর্ব ত্যাগ করা উচিত নয়? এর পরেও যদি তুমি স্থির থাকো যে আমার এ মুখ তুমি দেখবে না আমি তোমায় সেই অনুরোধও করব না। তুমি আমাকে এতকাল শুধু বাবার ছেলে হিসেবেই দেখে এসেছ, এরপর দেখো আমি তোমারও পুত্র। তুমি এক পা না এগোলে আমিও এক পা এগোব না। ইতি, তোমার…