নিতু অধৈর্ষ হয়ে বলল, কিন্তু? লিণ্ডা বলল, কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ট্রামের মধ্যেই। আমি সেদিনও সকালের হাওয়া খাব বলে দাঁড়িয়েছিলাম ফুটবোর্ডে। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার কাঁধে একরাশ সোনালি চুল ভর করছে। ঠিক সেই রকম চুল যা কিছুদিন আগে অবধি আমার মাথা থেকে ঢলে পড়ত। আমি চুলটা কার দেখার জন্য মাথা ঘুরিয়ে মানুষটির দিকে চাইলাম। আর আইলিনকে দেখলাম। আমার চুলটাকেই উইগ করে পরে আছে মেয়েটা আর আমার দিকে চেয়ে মিটি মিটি হাসছে। আমার মাথা টাল খেতে লাগল। সমস্ত মাঠটা চোখের সামনে পাক খেতে লাগল। আইলিন শুনলাম বলছে, আমি তোকে মাঠে হারাব বলেছিলাম। দেখলি তো কথা রেখেছি। তোকে খেলতে দিইনি। আমি বললাম, কিন্তু এখন আমায় বাঁচতে তো দিবি। আমার পাশ থেকে সরে যা, প্লিজ! ও হেসে বলল, নিশ্চয়ই। তারপর আমার হাতটা ধরে এক ঝটকায় আমাকে সঙ্গে নিয়ে নীচে নামল। তারপর সব।
অন্ধকার।
নিতু শিউরে উঠে বলল, তারপর?
লিণ্ডা বলল, মরে যাওয়ার পর একটাই আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল আমার। আমার সোনালি চুল। যে চুল নাকি আইলিনের সঙ্গে ওর কফিনে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম না কোন কবরখানায় কোন পাথরের নীচে আইলিন শুয়ে আছে। আমার এই তুখোড় ডান হাতটা কেবলই খুঁজে বেড়ায় ওই চুল। আইলিনের পাশ থেকে তুলে এনে আমার মাথায় রাখব বলে।
নিতু জিজ্ঞেস করল, তোমার ডান হাত?
-কেন, কাল দুপুরে যে-হাত দেখলে তুমি!
নিতু তোতলামি করতে করতে বলল, ওই যে কাটা হাতটা নিজের থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কবরে, ওটা তোমার হাত?
লিণ্ডা হাসল। নিতু এবার ওর ডান হাতটার দিকে তাকিয়েই ভয়ে চিৎকার করে উঠল, মাগো। দেখল সুন্দরী ফরসা ধবধবে মেয়েটির ডান হাতের কবজির কাছ থেকে কিছু নেই। দেখল লিণ্ডা তখনও হেসে চলেছে নীরবে, ওর সোনালি চুল খুটো খুটো করে কাটা। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আজ তোমার কাছে আসার আমার একটাই উদ্দেশ্য। তোমাদের ড্রাইভারের ঘরে আমার চুলটা আছে। ওটা বার করে এনে দাও আমাকে প্লিজ।
হঠাৎ ভীষণ সহানুভূতি আর ব্যথা অনুভব করল নিতু লিণ্ডার জন্য। বলল, কিন্তু তোমায় কোথায় পাব? এখানেই? তারপর নিজের চারপাশে তাকিয়ে নিতু দেখল ও অন্ধকারে, বিছানায় শুয়ে। কোথায় লিণ্ডা? কোথায় কে!
কিন্তু ঘুম ভেঙে গিয়েছে নিতুর। আর চোখের পাতায় ভর করে আছে লিণ্ডার করুণ দুটি চোখ। সোনালি চুলের আশায় কাতর প্রার্থীর মতো চেয়ে আছে। কী মনে করে নিতু হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে পা টিপে টিপে নেমে এল একতলায় অবনীদার ঘরের সামনে। তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখল নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে অবনীদা। তার পাশে একটা ছোট্ট, ভাঙা টেবিলে শোয়ানো আছে একরাশ অদ্ভুত সুন্দর সোনালি চুল। নিতু চুলের গোছাটা তুলে নিঃশব্দে বাড়ির গেট খুলে বেরিয়ে গেল পাশের কবরখানার দিকে। যে কবরের দিকে রাতেরবেলায় চোখ মেলে চাইতেও বুক ঢিপ ঢিপ করত নিতুর আজ সেই কবরের দিকে এই শেষরাতে কী এক অদ্ভুত শক্তি যেন ওকে অবলীলায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নিতু যেন স্বপ্নের ভেতর হেঁটে যাচ্ছে একটা স্বপ্নের মানুষের দিকে।
চারপাশে অন্ধকার, কিন্তু নিতু কীরকম পরিষ্কার দেখছে সব কিছু। কে যেন ওকে ভেতরে ভেতরে বলেও দিচ্ছে এদিকে এসো, ওদিকে চলো…তারপর একসময়, এখানে থামো।
নিতু থেমে পড়ার পর খেয়াল করল যে, যে-কবরে এসে দাঁড়িয়েছে ও সেটিই দুপুরে জেঠুর জানালা দিয়ে দু-চোখে গিলছিল। ও হাঁটু মুড়ে বসে হাতের চুলের দলাটা পাথরের ফাটলের পাশে রাখল। তারপর হাত দিয়ে ধুলো মুছে পড়তে শুরু করল পাথরের ওপর খোদাই করা নামটা। দেখল লেখা আছে একটি নারীর নাম। আইলিন হোয়াইট।
এই কি তা হলে লিণ্ডার সেই প্রতিদ্বন্দ্বী? কথাটা মনে হতেই নিতু ফের নামের নীচটা ঘষতে লাগল। দেখল মাত্র উনিশ বছরে মৃত্যু হয়েছে মেয়েটির।
এখানেই কি লিণ্ডা চেয়েছিল ওর চুল রাখা হোক? ভাবার সঙ্গে সঙ্গে নিতু ফের তাকাল পাশে ফেলে রাখা সোনালি চুলের দিকে। আর দেখল একটা ফর্সা, সুন্দর হাত—কবজি থেকে ছিন্ন-সোনালি চুলটাকে আঁকড়ে ধরে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে ঘাসের পথ ধরে।
উষাকালের নরম আলোয় এরকম একটা দৃশ্য দেখে এতটুকু ভয় পেল না নিতু। ও গভীর মনোযোগে দৃশ্যটা দেখতে দেখতে ভুলে গেল কেন বসে আছে এখানে। যখন হাত আর চুল মিলিয়ে গেছে গাছে আর ঘাসের আড়ালে তখনও ও ওই দিকে চেয়ে রইল।
আর তখন পুব আকাশে সূর্যোদয় হল। পরসাদী গোয়ালার রামগান শুরু হল। নিতুর মনে পড়ল এক্ষুনি জেঠু উঠবে, বাবা উঠবে, মা উঠবে। আর দেখবে নিতু ঘরে নেই। বাপরে! বলে নিতু বাড়ির দিকে ছুট লাগাল।
স্বপ্নের বারান্দা
আর এই সেই বারান্দা যেখানে বসে মা আকাশের তারা দেখতেন!–ঐতিহাসিক অট্টালিকার গাইডদের মতো একটা টোনে কথাটা বলে শুভেন্দু তাকিয়ে রইল আমার চোখের দিকে। ও জানে কথাগুলো আমার কানে উপহাসের মতো শোনাবে। ওর চোখের দিকে চোখ ফেলতেও আমার ঘেন্না করছে; অনেক সাবলীল এবং ভদ্র হত যদি ও সাফ-সাফ বলত, আর এখান থেকেই তোমার মা ঝাঁপ দিয়ে ওই রাস্তায় গিয়ে পড়েছিলেন।
শুভেন্দুর দিকে আমি তাকিয়ে আছি ঠিকই, কিন্তু আমার চোখে এই অতিশয় বিনয়ী, ভদ্রলোক ভগ্নীপতিটির চেহারার কিছুই ধরা দিচ্ছে না। আমাকে ও অমানুষ ভাবে, কিন্তু আমি ওকে কিছুই ভাবি না। ওর মাথার পিছনের নীল আকাশটাই দেখছি আমি, রাত হলে যে আকাশের তারা দেখত মা। একটু আগেই রানি বলছিল, দাদা, তুই কখনো অ্যাদ্দিনে আকাশের দিকে তাকিয়ে মা-র কথা ভাবিসনি? আমি কীরকম বিরসভাবে উত্তর করেছিলাম, ওকালতি শুরু করার পর আমার খুব একটা আকাশ দেখার ফুরসত হয়নি।