নামটা শুনেই একটা বিদ্যুৎ খেলে গেছে নিতুর মনে। নামটা তো কতবার শুনেছে দিদির কাছে। সেই যে মেয়েটা দারুণ বাস্কেটবল আর টেবিল টেনিস খেলত, দুর্ধর্ষ নাচত বিলিতি গানের তালে তালে, আর একদিন ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে গড়ের মাঠে ট্রাম থেকে পড়ে কাটা গিয়েছিল যার হাত। সমস্ত কাগজে এই ঘটনা ছেপে বেরিয়েছিল। দিদিদের ইশকুলের প্রাক্তন ছাত্রী ছিল লিণ্ডা। যেদিন লিণ্ডা মারা গিয়েছিল হাসপাতালে সেদিন ছুটি হয়ে গিয়েছিল দিদিদের স্কুলে। ওর আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা সভায় মাদার কেভিন ওর নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য গোল্ডেন হেয়ার্ড বিউটি’! সোনালি চুলের সুন্দরী।
হঠাৎ নিতু বলে উঠল, লিণ্ডা আমি তো তোমায় চিনি! তুমি লোরেটোর মেয়ে না? তুমি ভালো টেবল টেনিস খেলতে না? তুমি ট্রাম থেকে পড়ে গিয়েছিলে?
লিণ্ডা বলল, না।
চমকে উঠে নিতু বলল, সে কী! আমি তো তাই শুনেছি।
লিণ্ডা শান্ত গলায় বলল, সব্বাই তাই শুনেছে। কিন্তু সেটা ঠিক না।
—ঠিকটা তা হলে কী?
—আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
—ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল?
—আমার প্রিয় বান্ধবী আইলিন।
-তোমার প্রিয় বান্ধবী তোমাকে–
হ্যাঁ। ভারতের মহিলা বাস্কেটবল টিমে একটাই জায়গা ছিল। সেখানে ও যাবে নয় আমি। আইলিন জানত যে, আমি থাকতে ও ওই জায়গাটা পাবে না। তাই আমাকে বলেছিল, তুই টেবিল টেনিসে কিংবা ক্যাবারে ডান্সেও নাম করতে পারিস। আমার কিন্তু এই একটাই খেলা। এই জায়গা আমি তোকে নিতে দেব না, দেখিস। আমি তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারিনি, কারণ ও একটা চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু বিকেলে ট্রেনিং সেরে ফেরার আগে ট্রেনার রামনাথ দুবে স্যারকে বললাম ইণ্ডিয়ান টিমের জন্য আমার নাম না পাঠাতে। কিন্তু স্যারকে এটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম যে, আইলিন যেন একথা না জানে। কিন্তু স্যার আমার প্রস্তাবে মুগ্ধ হয়ে আইলিনকে ফলাও করে সব বলেছিলেন। আর তাতেই গরিব ঘরের মেয়েটির আত্মসম্মানে লেগেছিল। যেদিন টিম অ্যানাউন্সমেন্টে জানা গেল ভারত দলে ও আছে, আমি নেই ও আমাকে টেন্টের গেটের পাশে দাঁড় করিয়ে বলল, তুই এই অপমানটা আমাকে না করলেও পারতিস। আমি তোকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। তুই সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করে আমাকে অন্যভাবে হেয় করলি। আমি তোকে দেখে নেব। ওর এই কঠিন কথাগুলো শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম এবং ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করে ওকে বোঝাব আমি ওকে ভালোবেসেই যা কিছু করার করেছি।
নিতু আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারল না, উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলে উঠল, কিন্তু ও তাই বলে তোমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল? লিণ্ডা হাসল। বলল, ঠিক সেজন্য নয়। ও আমাকে দ্বিতীয় বারের মতোও ভুল বুঝেছিল। নিতু জিজ্ঞেস করল, কীরকম? লিণ্ডা খুব বিষণ্ণ মুখে বলল, ওকে না বুঝে আহত করার জন্য আমি যে কী ভীষণ লজ্জিত তা বোঝাবার জন্য আমি পরের দিন সন্ধ্যায় ওর বাড়িতে গেলাম আর ওকে আদর করে বুকে টেনে ওর হাতে একটা উপহারের বাক্স তুলে দিলাম। ও কিন্তু আমাকে দেখেই যারপরনাই চমকে গিয়েছিল। ওর মুখ দিয়ে একটা কথাও সরল না, ও শুধু হাঁ করে আমায় দেখে যাচ্ছিল।
এবার অবাক হওয়ার পালা নিতুর। ও জিজ্ঞেস করল, তোমায় ও হাঁ করে দেখছিল কেন? লিণ্ডা চোখ থেকে দু-ফোঁটা জল মুছতে মুছতে বলল, কারণ আমি আমার সমস্ত সোনালি চুল কেটে উপহারের বাক্সে তুলে দিয়েছিলাম ওকে। আমার প্রিয়তম জিনিস দিয়ে প্রিয়তম বন্ধুর দুঃখ ঘোচাতে চেয়েছিলাম।
নিতু বলল, তাতে কী হল?
লিণ্ডা বলল, তাতে ও আরেকবার রেগে গেল। বলল, জানিস লিণ্ডা, তুই খেলার মাঠের লড়াইটা ঘরে টেনে আনছিস। আমি তোকে মাঠে হারাতে চাই, তুই কিন্তু আমাকে মাঠের বাইরে আক্রমণ করছিস। আমি কিছু না বলে চলে এলাম। তখনও ও জানত না আমার সুন্দর চুলটাই গোছানো আছে উপহারের বাক্সে। পরের দিন সকালে ট্রেনিং-এ গিয়ে দেখি আইলিন আসেনি, খবর পাঠিয়েছে শরীরের কারণে ভারত দল থেকে নাম উঠিয়ে নিচ্ছে। দুবে স্যার এসে আমায় বললেন, সেক্ষেত্রে তোমাকেই দলে নিতে হচ্ছে লিণ্ডা। আমি ভাঙা মন নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ট্রামে উঠলাম, কিন্তু খালি ট্রামেও ভেতরে না গিয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম ফুটবোর্ডে। একবার ভাবলাম আইলিনকে দেখে আসি, পরমুহূর্তে ভাবলাম যদি ফের ও ভুল বোঝে। কিন্তু নিজের মনের সঙ্গে অনেক ঝগড়া করে শেষে চলেই গেলাম ওকে দেখতে। কিন্তু হায় কেন যে গিয়েছিলাম ওকে দেখতে!
উদবিগ্ন স্বরে নিতু বলল, কেন, ও কি ফের তোমাকে অপমান করল?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিণ্ডা বলল, না। সে উপায়ই ওর ছিল না, ও আমার সোনালি চুলে গলায় ফাঁস বেঁধে মরে পড়েছিল বাথরুমে।
নিতুর ছছাট্ট মগজে যে একটা মস্ত বাজ পড়ল। ও কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বলল, কিন্তু তুমি যে বললে আইলিনই তোমাকে ধাক্কা দিয়েছিল।
লিণ্ডা বলল, ঠিক। আর কেউ জানে না সেটা। কিন্তু আমি জানি। ভারত দলের হয়ে ভারতের বিভিন্ন শহরে খেলে আসার পর সেদিন সকালে প্র্যাক্টিসে গিয়ে খুব মন খারাপ করছিল। সবাই দেখলাম কীরকম গোমড়া গোমড়া। সবারই ধারণা আমি দেশের হয়ে আমার সেরা খেলা উজাড় করে দিতে পারিনি। কিন্তু কেউ জানেনি আমার সমস্যা। সারাক্ষণ খেলার সময় আমার মনে হয়েছে আমার পায়ে পায়ে এক অদৃশ্য খেলোয়াড় ছুটছে। শুধু বিপক্ষের খেলোয়াড় নয়, আমাকে বল নিয়ে দৌড়োতে হচ্ছে ওকে কাটিয়ে কাটিয়েও। ফলে সারাক্ষণ ভুলভ্রান্তি করছি। আমি চুপ করে সমস্ত সমালোচনা শুনলাম, তারপর মুখ বুজে উঠে এলাম আইলিনের বাড়ি যাব বলে। কিন্তু …।