অবনীদা হঠাৎ করে বুঝে উঠতে পারেনি নিতু কী বলছে। তাই জিজ্ঞেস করল, কী বললে নিতু? নিতু আমতা আমতা করে সেই কথাটাই বলল। অবনীদা এবার ভুরু কুঁচকে, একটু গম্ভীর চালে বলল, কেন, পরীক্ষায় ডিগবাজি খেয়েছ? নিতু জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ধ্যাৎ!
-তা হলে?
—আজ দুপুরে একটা কাটা হাত দেখেছি কবরে।
অবনীদা প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলল, কাটা হাত! কার হাত?
-সে আমি কী জানি! তুমি গিয়ে দেখে এসো।
অবনীদা ধুর! বলে ফের সিগারেটে টান দিল। নিতু বেশ অভিমান করে চুপ করে রইল। তখন গাল ভরতি ধোঁয়া বেশ কয়েকটা রিং করে হাওয়ায় ছেড়ে অবনীদা বলল, বেশ, আমি গিয়ে দেখে আসছি। কিন্তু কোন কবরটা?
নিতু বলল, সে তুমি খুঁজে পাবে না। আমি সঙ্গে যাচ্ছি চলো।
সারাটা দুপুর ভয় পাওয়ার পরেও কী এক অদম্য কৌতূহল ওকে পেয়ে বসেছে। যে দৃশ্যটা থেকে ওর এত ভয়, সেই দৃশ্যটাই কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখার জন্য মন আনচান করছে ওর এখন।
অবনীদা বলল, এই বললে ভয় করছে। এখন বলছ সেখানেই যাবে? তারপর গলাটা বেশ কড়া করে ধমকের সুরে বলল, গাঁজা তো খায় পরসাদী জমাদার। আর উলটোপালটা ব্যাপার দেখছ তুমি।
নিতু কোনো কথা না বলে অবনীদার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল।
বিকেলের শেষ, নরম রোদ তখন গাছের ডালপালাতেই আটকে গেছে। আর ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু ঝরে পড়েছে ভাঙা কবরগুলোয় তাতে জায়গাটাও বেশ মনোরম লাগছিল। নিতু একটা লাইন ধরে গুনতে গুনতে হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘অবনীদা! এইটা!
কিন্তু অবনীদা কই? ইতিউতি চেয়ে হঠাৎ নিতু দেখল অবনীদা হাঁটু মুড়ে কী একটা দেখছে। ও ফের হেঁটে গেল অবনীদার কাছে। আর কাছাকাছি হতেই ওর চোখে পড়ল এক পুরোনো কবরের মস্ত ফাটল। ও গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী দেখছ, অবনীদা? অবনীদা মাথা সেই নীচে মাটির দিকে ঝুঁকিয়ে রেখে বলল, একপাটি জুতো।
—একপাটি জুতো! কেন, তোমার চটি তো তোমার পায়েই আছে?
—আমার না। এটা মেমসাহেবের জুতো।
–মেমসাহেবের জুতো?
অবনীদা এবার মাথা তুলে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, এইমাত্র জুতোটা পাথরের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ল নীচে।
বলেই একটা গাছের ভাঙা ডাল নিয়ে গর্তটায় খোঁচাতে লাগল অবনীদা। নিতু বলল, খোঁচাচ্ছ। শেষে সাপ বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু অবনীদা ওর কথায় কান না দিয়ে খুঁচিয়ে চলল। কিন্তু জুতোর বদলে কিছুক্ষণ পর অবনীদা যেটা টেনে বার করল সেটা এক গোছা সোনালি চুল।
-বাপরে! এ তো মেমসাহেবের চুল! এত তাজা চুল কোত্থেকে এল?
নিতুর ভেতরে ভেতরে কে যেন বলল, যার হাত দেখেছ দুপুরে এই চুলও তার। নিতুর শরীরে হঠাৎ শীত শীত ভাব হল। ও অবনীদাকে ফেলেই বাড়ির দিকে ছুট লাগাল। দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে যখন ও দোতলায় তখন রোদের প্রায় সবটাই চাপা পড়েছে। জজবাড়ির দেওয়ালে, আর অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে মোটামুটি।
দোতলায় বাবার সেরেস্তা থেকে কাজ সেরে নামছিলেন বাবার অ্যাসিস্ট্যান্ট সৌরীন কাকা। নিতুকে ওভাবে দুদ্দাড় করে উঠতে দেখে বললেন, কীরে! তোর আবার এত তাড়া কীসের? কোথায় ছুটলি? নিতুর কিন্তু এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ফুরসত নেই। ওকে এক্ষুনি জেঠুর ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে হবে সোনালি চুল দিয়ে অবনীদা কী করছে। অন্ধকার নেমে গেল বলে, এই সুযোগে না দেখলে পুরো ব্যাপারটা আরও গোলমেলে হয়ে যাবে। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে সৌরীন কাকার উদ্দেশে ও শুধু দুটো শব্দ ছুড়ে দিল—খিদে পেয়েছে।
কিন্তু জেঠুর জানালা থেকে নিতু যে দৃশ্য দেখল তাতে ওর বুক হিম হয়ে গেল। হঠাৎ করে গলাটা যেন বন্ধ হয়ে আসল, কে যেন টিপে ধরছে। একটু-আধটু চেঁচাবে তারও উপায় নেই। ও মরে যাওয়া আলোয়, বলতে গেলে সদ্য নামা অন্ধকারে, জানলার দিকে মাথা রেখে দেখল দূরের একটা কবরের পাশে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে অবনীদা!
চোখে প্রচুর জলের ঝাপটা, দু-গ্লাস গরম দুধ আর হাত-পা রগড়ানির পর অবনীদা শুধু বলতে পারল যে কবরের গর্তে একরাশ সোনালি চুল পাওয়ার পর সে আরেকটু খুঁচিয়ে দেখতে গিয়েছিল আর কী আছে সেখানে। সে-সময় হঠাৎ একটা শ্বাসকষ্ট শুরু হল এবং অবনীদার মনে হল যে, পাশে ফেলে রাখা চুলটাই যেন কে গলায় জড়িয়ে দিচ্ছে আষ্টেপৃষ্ঠে। কিন্তু দোহাই মা দুর্গার, অবনীদা কিন্তু ঘুণাক্ষরে নিতুর নাম করেনি। তা হলে জেঠুর হাতে আর রক্ষা থাকত না!
রাত্রেও শোওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে দুপুরের সেই হাত আর বিকেলের সেই সোনালি চুল চোখের সামনে ভাসল। তারপর কখন এক সময় ভারী ঘুমে ঢলে পড়ল নিতু। আর তারপর একসময় অতল নিদ্রায় কোন এক পর্যায়ে এক অদ্ভুত স্বপ্ন ভর করল ওর দুই চোখে। ও দেখল এক পরমাশ্চর্য সুন্দরী মেয়ে, যেমনটি ও বিলিতি ছবির বইয়েই দেখেছে, একলা বসে কাঁদছে বাড়ির পাশের ওই কবরখানার একটা পাথরে বসে। নিতু পা টিপে টিপে ওর পাশে গিয়ে ইংরেজিতে বলল, তুমি কাঁদছ কেন? কে-ই বা তুমি?
সেই মেয়ে-কতই বা বয়স হবে? উনিশ-কুড়ি? বাঁহাত দিয়ে ওর চোখ মুছে ভাঙা গলায় বলল, তুমি কেন আমার নাম জিজ্ঞেস করছ? তুমি কি আমায় চিনবে?
নিতু বলল, নাম ছাড়া কাউকে কি চেনার চেষ্টাও করা যায়? মেয়েটি এবার বলল, আমার নাম লিণ্ডা। লিণ্ডা ফাটাডো। তাতে কিছু সুবিধে হল?