–না, ও আমার অভ্যেস আছে।
অরুণা বলল, প্রিয়, যদি ছাতা ধরে পাশাপাশি আসি?
কী একটা ভেবে একটু চুপ থেকে প্রিয়ব্রত বলল, না থাক, সন্ধ্যেটা ভালো নয়।
সোনালি চুল
বাড়ির পাশেই কবরখানা থাকলে ব্যাপারটা কীরকম হয় তা আর পাঁচজনের পক্ষে অনুমান করা সহজ নয়। নিতু সেদিক দিয়ে ভারি ভাগ্যবান। জ্ঞান হওয়া থেকেই ও জেঠুর জানালায় বসলেই সারি সারি কবর দেখতে পায়। অনেক কবরই পুরোনো হয়ে ধসে পড়েছে, আবার বেশ কিছু কবরের চেহারা বেশ শক্তপোক্তই আছে। সকালের আলোয় অথবা পড়ন্ত রোদে কবরখানার দিকে চেয়ে বসে থাকলে দিব্যি সময় কেটে যায় ওর। শেষ কবে এই গোরস্থানে কাউকে গোর দেওয়া হয়েছে সেটা নিতুর জানার কথা নয়। জেঠু বলে, সে তো খুব কম দিনের কথা না। বছর পঁচিশ তো হবেই। সেই শুনে নিতু হাল ছেড়ে দিয়েছে। ওর দশ বছরের জীবনে ও শুধু সারি সারি কবরই দেখে গেল। সবুজ ঘাস আর খান আষ্টেক গাছের ছায়ায় সাদা কিংবা ছাই ছাই রঙের কবরগুলোর এক অদ্ভুত চেহারা। দুপুর বেলা নিতু ঘুমোবার অছিলায় জেঠুর ঘরে এসে নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকে কবরগুলোর দিকে। এভাবেই তাকিয়ে থাকতে থাকতে একদিন ও সেই দৃশ্যটা দেখে ফেলেছিল।
নিতু তাকিয়েছিল একটা গাছের ছায়ায় আত্মভোলাভাবে শুয়ে থাকা একটা পুরোনো, ভাঙা কবরের দিকে। কবরটার গায়ে মোটা-মোটা, কালো কালো ফাটল। জেঠু বলে, নিতু, খবরদার ওইসব কবরে গিয়ে বসিস না, সাপখোপ থাকতে পারে। জেঠু যে খুব একটা ভুল বলেছিল তাও না। কারণ একদিন দুপুরে বৃষ্টির পর নিতু হাঁটতে গিয়েছিল কবরখানায়। আচমকা দেখল একটা কালো, মোটা সাপ ঘাসের ভেতর থেকে উঠে সুড়সুড় করে ঢুকে গেল কবরের গর্তে। সে-কবরটা যে কোনটা নিতুর মনে নেই, শুধু মনে আছে সাপটাকে দেখে কীরকম একটা ঠাণ্ডা বাতাস খেলে গিয়েছিল ওর শিরদাঁড়া দিয়ে। তারপর থেকে কোনো কবরের ওপর বসতে গেলে নিতু জায়গাটা আগে দেখে-টেখে নেয়, দরকার হলে এক মুঠো ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে একটু-আধটু মুছে-টুছেও নেয়। তো যাই হোক, ওরকম একটা পুরোনো কবরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখল সাদা মতো কী একটা পড়ে আছে সেটার ওপরে। প্রথমে ভেবেছিল ওটা হয়তো কারও ফেলে যাওয়া রুমাল। তারপর হঠাৎই দাদুর কথা মনে আসাতে ভাবল হয়তো বা কোনো সাপের ছাড়ানো খোলস। এটা মনে হতেই একটা রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়ল ওর শরীরে। সাপের খোলসের কথা তো এতদিন বইতেই পড়ে এসেছে। এবার সাক্ষাৎ দেখা হবে। ও আরও মনোযোগ দিয়ে চেয়ে রইল বস্তুটির দিকে। এবং হঠাৎই দেখল সেটা নড়ছে। আরেক ধাক্কা বিস্ময় এবার। নড়াচড়া করলে আর সাপের খোলস বা রুমাল হয় কী করে। তা হলে ওটা কী? নিতু আরও খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে জমে পাথর হয়ে গেল। সাদা হালকা জিনিসটা একটা মানুষের পাঞ্জা! কবজি থেকে আঙুলের। ডগা অবধি। আঙুলগুলোকে পা হিসেবে ব্যবহার করে টুকটুক করে চলে মিলিয়ে গেল কবরের ফাটলে! দিনদুপুরে এরকম ঘটনা দেখে প্রথমে বরফ হয়ে গেল নিতু, তারপর শরীরে তাপ ফিরে পেতে ‘মা!’ বলে এক বিকট চিৎকার দিয়ে ও দৌড়ে গেল বাড়ির ওধারে মা-র ঘরে! গিয়ে মাকে ঘুমন্ত দেখে এক লাফে মা-র পাশে শুয়ে ও চোখ বন্ধ করে হাঁপাতে লাগল।
.
নিতু শুয়ে রইল বহুক্ষণ, কিন্তু ঘুম জিনিসটা কিছুতেই এল না। ও ভেবে পেল না বাড়ির কাকে একথা আদৌ বলা যেতে পারে। বিশ্বাস তো কেউই করবে না, উলটে দুপুরে জেঠুর ঘরে বসে কবর দেখাটাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এসবই ভাবছিল নিতু মটকা মেরে পড়ে, আর সেই সঙ্গে একটা মৃদু কাঁপুনি অনুভব করছিল জেঠুর কাছে শোনা ড্রাকুলার কাহিনির জায়গা-জায়গা মনে পড়ে। এর আগেও নিতু বহুবার ভয় পেয়েছে—অঙ্ক স্যারের ডাস্টারপেটা, মা-র হাতে উত্তম-মধ্যম, পাগলা ষাঁড়ের তেড়ে আসা, একদিন ছাদে কালবৈশাখীর ঝড় দেখে, আরেকদিন রাতে ছাতের সিঁড়িতে পা হড়কে পড়ে—কিন্তু সেসব ভয় এর থেকে একেবারে আলাদা। কোনো ভয়ই যেন ঠিক এরকম নয়। সব চেয়ে খারাপ হল যে, এতখানি ভয় পাওয়ার পরও ভয়টা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। কীরকম ঘুরে ঘুরে আসছে। কাউকে এটা বলতে না পারলে এ ভয় যাওয়ার নয়। কিন্তু বলবেটা কাকে? শুনবেই বা কে? আর বিশ্বাসই বা কে করবে?
বিকেলের শেষ দিকে, যখন রোদ পড়ে আসছে, নিতু ছাদের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু সিঁড়িতে পা দিতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ভুল করে যদি ছাদ থেকেও চোখ চলে যায় কবরের দিকে? প্রথমে নিতু ভাবল, গেলই বা ওদিকে? তাতে কী হয়? তারপরেই ভাবল, যদি ওই কাটা হাতটা ফের—নিতু সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা লাগাল বাড়ির নীচে গোরুর গোয়ালে। জগরু নিশ্চয়ই এতক্ষণে গোরু দুইয়ে হাত-পা ছেড়ে বিড়ি ধরিয়ে খাঁটিয়ায় বসে গেছে। ওকে না হয় মন খুলে ব্যাপারটা বললে হয়। কিন্তু এরপরেও একটা দুশ্চিন্তা ভর করল নিতুকে। ভাবল, জগরুটা তো গবেট। কোনো কথা পুরো শোনার আগেই হাঁ হাঁ করে ওঠে। তারপর কী যে বকবক করে! নিতু ঠিক করল, না! ওকে বলবে না।
কিন্তু গোয়ালের মুখটায় পাতা খাঁটিয়ায় জগরুকে নয়, বাবার ড্রাইভার অবনীদাকে খুঁজে পেল নিতু। অবনীদা সবে কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরে এসে মনের সুখে একটা পাসিং শো সিগারেট ধরিয়েছে। নিতু গুটি গুটি অবনীদার পাশে গিয়ে বসে বলল, আমার বেশ ভয় করছে, অবনীদা।