হঠাৎ সিগারেটের স্বাদটা কেমন কটু হয়ে এল মুখের মধ্যে ; প্রিয়ব্রত সিগারেটটা টিপে নিভিয়ে ফেলে দিল অ্যাশট্রেতে। তারপর উদবিগ্নভাবে চেয়ে রইল অরুণার মুখের দিকে, কিছু শোনার জন্য। অরুণা বলল, সিগারেটটা নষ্ট করলেন?
প্রিয়ব্রত বলল, জিনিসটাই তো নষ্ট। ওর আর নষ্ট করার কী আছে?
অরুণা বলল, আপনার বন্ধু সব কিছু ছাড়তে পেরেছিল। কেবল সিগারেটটাই পারেনি।
প্রিয়ব্রত মগজে একটা শিহরন বোধ করল, সব কিছু ছেড়েছিল মানে?
—যেমন ডাক্তারির প্র্যাক্টিসটাই।
—সে কী? কী করত তাহলে?
—একটা রিটার্ডেড শিশুদের ইস্কুলে ভলান্টারি সার্ভিস। আর বাকি সময়ে একটা উপন্যাস লিখত বাংলায়।
প্রিয়ব্রতর কৌতূহল তখন আর বাধা মানছে না ; চঞ্চলের মতো বাস্তবিক চঞ্চলমনা ও চঞ্চলস্বভাব ছেলে প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবায় আর উপন্যাস লেখায় ব্যস্ত।
মানুষটার হয়েছিল কী?
প্রিয়ব্রত যে রীতিমতো চমকে গেছে তা আঁচ করে অরুণা বলল, সবটাই ঘটল ওর ক্যান্সার ধরা পড়ায়। ওর দুরারোগ্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সন্ধ্যেবেলায় একেবার অন্তত পাব-এ টু মেরে বিয়ার খাওয়া, চলনে-বলনে, কেতা-কানুনে ব্রিটিশের মতো ব্রিটিশ হয়ে ওঠা, সপ্তায় একবার করে ওয়াই এম সি-তে ব্যাডমিন্টন খেলা এবং একশো অজুহাতে দেশে না-ফেরা—সবই নিমেষে উবে গেল লিভারে ক্যান্সার ধরা পড়ায়। হঠাৎ করে ওর মনে হল সেদিন ও একটা ভুল জীবনযাপন করে এসেছে এতদিন। বলল, যে-ক-টা দিন বাঁচি একটু সংশোধন করে নেব নিজেকে।
প্রিয়ব্রত জিজ্ঞেস করল, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ আর উপন্যাস লেখা কি ওর প্রায়শ্চিত্তের অঙ্গ?
অরুণা বলল, হ্যাঁ। আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাও প্রায়শ্চিত্ত।
—কিন্তু কেন? আমার প্রতি কী অন্যায় করেছে ও?
–আপনাকে ক্ষমা করতে পারেনি বলে।
–কেন, কীসের ক্ষমা?
–আমাকে এক সন্ধ্যার ভালোবাসার জন্য।
ফের নীরব হয়ে পড়ল প্রিয়ব্রত ও অরুণা। এরপর কথা চালাবার মতো ভাষা বা বিষয় হারিয়ে ফেলেছে দু-জনই। দু-জনেরই একটু একটু কষ্ট হতে লাগল চঞ্চলের জন্য। মাত্র একটা সন্ধ্যের কারণে একটা মানুষ এত কষ্ট পেতে পারে। শেষে ঠিক এই প্রশ্নটাই অরুণাকে করে বসল প্রিয়ব্রত-চঞ্চলটা এত সেন্সিটিভ ছিল? নাকি সন্দেহবাতিক?
অরুণা বলল, ঠিক বুঝতে পারিনি কোনোদিন। যে কারণে দেশে এসে কখনো দেখা করিনি। ও তো আসেনি কোনোবারই।
-তাহলে এবার দেখা করলেন…
—এ তো ওরই চাওয়া বলেছিল, দেখা করে ওকে বোলো আমি ওকে ভুলিনি। ঘৃণাও করিনি। শুধু ভালোবাসাটা থমকে গিয়েছিল।
-কেন? অরুণা ওর পাশে রাখা একটা মস্ত ফাইল তুলে নিয়ে প্রিয়ব্রতর দিকে এগিয়ে ধরল— বলেছে, সব ধরা আছে এতে।
—ওর উপন্যাস।
–আপনি পড়েছেন?
অরুণা নম্রভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝাল হ্যাঁ।
—কেমন বুঝলেন?
—সে তো আপনি বলবেন।
–কেন, আপনি নন?
—কারণ এটা আপনার আর ওর বোঝাপড়া।
প্রিয়ব্রত ভারী ফাইলটা আস্তে আস্তে খুলে প্রায় ছ-শো পাতার পান্ডুলিপিটা বার করল। আর থমকে গেল উপন্যাসের শিরোনামে। বড়ো বড়ো হস্তাক্ষরে সাইন পেনের কালো, মোটা কালিতে লেখা সেই আশ্চর্য সন্ধ্যা।
অরুণা বলল, গোটা উপন্যাসটাই একটি সন্ধ্যার বিবরণে লেখা।
প্রিয়ব্রতর হাতদুটো কাঁপছিল, ও কোনোমতে শিরোনাম পৃষ্ঠা সরিয়ে পরের পাতায় এল —উৎসর্গপত্রে। সেখানে শুধু—অরুণাকে। তারপর পৃষ্ঠা উলটে যে-পাতায় এল সেখানে শুধু একজন কবির একটা পঙক্তির উদ্ধৃতি। জোসেফ ব্রডস্কি-র একটা লাইন : অ্যাজ ডার্ক অ্যাজ দ্য ইনসাইড অব আ নিডল। একটা ছুঁচের মধ্যে নিহিত অন্ধকারের মতো।
প্রিয়ব্রতর বড়ো বড়ো শ্বাস উঠতে লাগল। ও বুঝতে পারল না এ উপন্যাস নিয়ে ও কী করবে। তবু অদম্য টান অনুভব করছে ও লেখাটা একনিমেষে পড়ে ফেলার। ও পাতা উলটে উপন্যাসের প্রথম পাতায় গেল…
ওয়েলিংটন পার্কের অন্ধকারে হঠাৎ আকাশ-জমি আলো-করা এক বিদ্যুৎচমকের আলোয় অরুণ প্রথম দেখল প্রিয়াকে। বিদ্যুৎ মিলিয়ে যেতে যে-ঘন, সজল অন্ধকার ঘিরে ফেলল চারপাশ, সেই অন্ধকারে ফের প্রিয়াকে দেখল অরুণ। আর দ্বিতীয় দেখাটা আরও গভীর, কারণ এতে বিদ্যুতের ছলনা নেই। ওর মনে হল সিক্তবসনা মেয়েটিকে ওর ছাতার নীচে আসতে বলবে, কারণ ওভাবে বুকে বই আঁকড়ে ও এই জলের মধ্যে কার অপেক্ষায়? এক ছাতার নীচে এলে দু-জনেই ওরা সমান ভিজবে, কিন্তু সমান উষ্ণও হবে। বর্ষার সন্ধ্যার চেয়ে প্রেমে পড়ার মতো ভালো সময় হয় না।…
আর পড়তে পারছিল না প্রিয়ব্রত, লেখাটাকে ওর অলৌকিক মনে হচ্ছিল। ওর আর অরুণার মনস্তত্ত্ব ঘেঁটে এ কী সাংঘাতিক প্রতিশোধ চঞ্চলের! এতশত ও জানল কী করে? কোত্থেকে?
অরুণা ম্লান হেসে বলল, না, আমি কিছুই বলিনি ওকে। সবই ওর নিজের কল্পনা। বলেছিল, কল্পনাই নাকি তৃতীয় নয়ন। ও চোখ বুজলেই নাকি আপনি, মানে প্রিয়ব্রত হয়ে যায়। তাই গোটা উপন্যাসটা আপনার দৃষ্টিতে লেখা। আমি একটা চরিত্র আর উপলক্ষ্য মাত্র।
ঠিক তখনই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। প্রিয়ব্রত বলল, লেখাটা নিয়ে যাচ্ছি। পড়া হলে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।
অরুণা উৎকণ্ঠার স্বরে বলল, কিন্তু আপনি যাবেন কী করে? কী সাংঘাতিক বৃষ্টি!
-কেন, আপনি যদি একটা ছাতা ধার দেন।
–তা তো পারি, কিন্তু এ যা বৃষ্টি। আপনার চশমায়…