কাশী চলে যেতে প্রিয়ব্রতর উৎকণ্ঠা ক্রমশ বাড়তে লাগল। নিজের চিঠির ভাষা নিয়ে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব গড়ে উঠতে লাগল। অরুণা তো সত্যিই প্রিয়ব্রতর জীবন নিয়ে কিছু জানতে চায়নি, নিজেরই ক-টা কথা বলার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল।
তাতে কি প্রিয়ব্রতর অমন একটা পত্রাঘাতের প্রয়োজন ছিল? আরও বিনীতভাবেই কি না যাওয়ার কথাটা বলা যেত না? কে জানে, এহেন প্রত্যাখ্যান কি মানুষ ভয় থেকে করে বসে? বাস্তব থেকে সরে দাঁড়ানোর কঠিন চাপে? প্রিয়ব্রতর মনে পড়ে গেল ওঁর প্রথম যৌবনের সেরা সঙ্গী সেন্ট অগাস্টিনের কনফেশনজ গ্রন্থের একটা উক্তি; বলেছিলেন—অধিকাংশ মানুষের পক্ষে নিখুঁত মিতাচার অভ্যাস করার থেকে কোনো নেশাকে সম্পূর্ণ পরিহার করা অনেক সহজ। প্রিয়ব্রত আপনমনে একবার আউড়ে নিল খ্রিস্টান সন্তের কথাটা—টু মেনি, টোটাল অ্যাবস্টিনেন্স ইজ ইজিয়র দ্যান পার্ফেক্ট মডারেশন।
ফের একটু দেরি করে ফেলেছে প্রিয়ব্রত। চিঠিটা পাঠিয়ে দেওয়ার পর ভাষা ও ভাবের কথাটা মনে এল। এখন কাশীর পিছন পিছন রওনা হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। অথচ তাতে যে কী সুফল বর্তাবে তাও তত খেলছে না মাথায়। তালতলা আর কতটুকু দূরত্ব। জামাকাপড় বদলে রওনা দিতে দিতে কাশী তো ওবাড়ি পৌঁছেই যাবে। আর অরুণার মুখোমুখি হয়ে প্রিয়ব্রত বলবেটাই বা কী? চিঠির বয়ান ভুলে যান, এই আমি হাজির। এটা কী বলার মতো কথা? এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ও ক্লান্ত বোধ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে গা এলিয়ে দিল ইজিচেয়ারে। মনের যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এর মধ্যে তাতে সন্ধ্যেবেলায় ওকে অরুণাদের বাড়ি একবার যেতেই হচ্ছে।
সিগারেটটা শেষ করে চোখ বুজে বসেছিল কিছুক্ষণ প্রিয়ব্রত, ঘরের পর্দা সরার আওয়াজে চোখ খুলতে দেখল কাশী হাতে একটা খাম নিয়ে দাঁড়িয়ে। বলল, দাদাবাবু, দিদিমণি এই চিঠিটা তোমায় দিল।
প্রিয়ব্রত খামটা নিয়ে চিঠিটা বার করে দেখল কেবল একটা বাক্য লিখে পাঠিয়েছে—‘আমি অপেক্ষা করব।’ কাগজটায় না আছে কোনো সম্বোধন, না কোনো স্বাক্ষর। অথচ তিনটি শব্দের চিঠি এক ভয়ানক দাবি বহন করে এনেছে। এরপর না যাওয়ার আর কোনো পথই রইল না প্রিয়ব্রতর, যাওয়াটা অনেক সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে গেল অতঃপর। প্রিয়ব্রত ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাড়ি কামানোর তোড়জোড় শুরু করে দিল।
সন্ধ্যায় কফির কাপটা প্রিয়ব্রতর দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে অরুণাই কথা শুরু করল, যেসব প্রশ্ন করব ভেবে আপনি ভয় পাচ্ছিলেন তার সব উত্তর তো আমি পেয়েই গেছি।
চমকে উঠে প্রিয়ব্রত জিজ্ঞেস করল, কী করে?
—কেন, আপনার চিঠি পড়ে!
কোনো নিঃসঙ্গ লোক ছাড়া অমন সন্ত্রস্ত হওয়ার কারণ তো কারও নেই।
—আর কী বুঝলেন?
-বুঝলাম যে সেই সন্ধ্যের ভালোলাগাটা অ্যাদ্দিনেও মুছে যায়নি।
নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়ল প্রিয়ব্রতর বুক থেকে। বুকটা একটু হালকা হতে ও জিজ্ঞেস করল, আপনি কী মনের ডাক্তারি পড়েছেন?
অরুণা হেসে বলল, এইটুকু বোঝার জন্য সাইকোলজি পড়তে হয় না, এটা সব মেয়েই কমবেশি পারে। না, আমার বিষয় সাইকোলজি নয়, অনকোলজি। মানে ক্যান্সার।
প্রিয়ব্রত কিছুটা রসিকতার ছলে কীরকম আনমনে বলল, না। ওই রোগটা এখনও ধরেনি। ধরলেই পারে। আজকাল তো…।
প্রিয়ব্রতকে কথা শেষ করতে দিল না অরুণা-কপাল এমনই, আমার এই বিদ্যে দিয়েই চিকিৎসা করতে হল আপনার বন্ধুকে।
কফির কাপটা প্লেটে ঠনঠন করে কেঁপে উঠেছিল প্রিয়ব্রতর হাতে, ও প্রায় ছিটকে উঠল যেন সোফা থেকে, কী বলছেন কী, অরুণা! চঞ্চলের … কথাটা আর শেষ হল না প্রিয়ব্রতর, তার আগেই গলাটা ভেঙে গেল।
অরুণা চোখ বুজে মাথা ঝাঁকিয়ে শান্তভাবে বলল, হ্যাঁ। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল ঘরে। দু-জনের কারওই কিছু বলার বা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছেটুকুও রইল না। আর সেই নীরবতায় প্রিয়ব্রত প্রথম ভোলা দৃষ্টিতে দেখল অরুণাকে।
দেখল অরুণার সিঁথিতে সিঁদুর নেই। অবশ্য লণ্ডনে প্র্যাক্টিস করা ডাক্তার সিঁদুর না-ই পরতে পারে। তবে সরু নীল পাড়ের সাদা সুতির শাড়িটার মধ্যেও কোথায় যেন একটা চাপা বিষণ্ণতা। অরুণার ফর্সা, সুন্দর মুখটায় কয়েকটা অকাল বলিরেখা। একটা আবছা ক্লান্তির ভাব। চোখদুটোয় একটা স্তব্ধ কান্না। ওকে দেখতে দেখতে বুকে কান্না জমছিল প্রিয়ব্রতর। ওর হাতে ধরা কফিটা ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে এল।
ওই ঠাণ্ডা কফিতেই চুমুক দিয়ে প্রিয়ব্রত বলল শেষে, হ্যাঁ, আপনার বোধ হয় কিছু বলবার ছিল? অরুণা চোখ খুলে একমুহূর্ত কী ভেবে, তারপর বলল, কথাটা আপনার বন্ধুর।
-কী বলেছিল চঞ্চল?
–ক্ষমা চেয়েছিল আপনার কাছে।
–ক্ষমা? আমার কাছে? কেন?
–এটুকুই বলতে বলেছিল। বলেছিল আপনি বুঝবেন।
প্রিয়ব্রতর মনের মধ্যে ফের সেই সন্ধ্যার অন্ধকার আর বিদ্যুতের ঝলকানি খেলে গেল। আর সেই বিদ্যুৎচমকে অরুণার সেই বৃষ্টিধোওয়া মুখ আর একজোড়া অসহায় চোখ। সত্যিই তো, বোঝার কিছুই বাকি রইল না প্রিয়ব্রতর। চঞ্চলের কাছে সেই সন্ধ্যার বর্ণনাই ভুল সুরে আলাপ ধরার মতন হয়ে গিয়েছিল। প্রিয়ব্রত পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট বার করে একটা সিগারেট ধরাল। বিব্রত বোধ করলে ওর বিশ্বস্ত সঙ্গী হল সিগারেট। সিগারেটের প্রথম ধোঁয়াটা সন্তর্পণে ছাড়তে ছাড়তে শুনল অরুণা বলছে—আপনার বন্ধুও শেষ অবধি সিগারেটটা ছাড়তে পারেনি।