আপত্তি এই জন্যই?
মেয়েটির ঠিকানা কী? চিঠি পড়ে তো মনে হয় তার বিয়ে হতে চলেছে; তাহলে? আর প্রেমেই যদি পড়েছিস তো এত দেরিতে টনক নড়ল কেন?
সবার সব মন্তব্য শোনানোর পর চঞ্চল নিজের প্রশ্নটা রেখেছিল, কই, আমাকেও তো কোনোদিন জানাসনি তোর একটা অ্যাফেয়ার আছে?
প্রিয়ব্রত চুপ করে হেসেছিল। তখন চঞ্চল পরের প্রশ্নটা করে—বলিস তো একবার মেয়েটার বাড়ি যেতে পারি। কী বলিস?
প্রিয়ব্রত ম্লান স্বরে বলেছিল, ছেড়ে দে। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। চঞ্চল জিজ্ঞেস করেছিল, তাহলে মাসিমা যেটা বলছিলেন …?
-মা কী বলছিল?
–কয়েকটা সম্বন্ধ এসেছিল, তোকে নিয়ে মেয়ে দেখতে …
—ডোন্ট বি রিডিকুলাস, চঞ্চল! তুই তো জানিস আমি বিয়ের জন্য মুখিয়ে নেই।
–তাহলে এটা কী ছিল?
–স্রেফ দু-ঘণ্টার একটা স্বপ্ন!
–কোথায় পেলি মেয়েটাকে?
—ওয়েলিংটন স্কোয়ারে। জলে দাঁড়িয়ে ভিজছিল।
–তাতে তুই এলি কী করে?
—দেখে বড্ড মায়া হল। কে জানে, ভালোও লেগে গিয়েছিল হয়তো! এগিয়ে গিয়ে ছাতা ধরলাম ওর মাথার ওপর।
-তারপর?
—তারপর পাশাপাশি হেঁটে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিলাম।
—কোথায় থাকে?
-তালতলায়।
-কী নাম?
–অরুণা। অরুণা রায়।
এরপর চঞ্চল আর বেশিক্ষণ থাকেনি। হঠাৎ ‘চলি’ বলে হুট করে চলে গিয়েছিল। বলেও যায়নি ফের কবে আসবে।
আসেওনি দেড় মাস। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে তখনও বেডরেষ্টে প্রিয়ব্রত। যখন চঞ্চলের বিয়ের নেমন্তন্নের কার্ড এল—বাই পোস্ট! খামটা খুলে চঞ্চলের জ্যাঠা অরবিন্দ বসুর নামে কার্ডটা দেখেই রাগে রি-রি করে উঠেছিল গা’টা। উনিশ বছরের বন্ধুত্বের এই চেহারা! সেই কবে কলিন্স ইনস্টিটিউটে ক্লাস সিক্সে পড়তে পড়তে আলাপ, তারপর…নাঃ, আর ভাবতেও বিচ্ছিরি লাগছিল প্রিয়ব্রতর! ও কার্ডটা না পড়েই বিছানার মাথার কাছে টেবিলে ছুড়ে ফেলে গত রাতের আধপড়া ডিটেকটিভ উপন্যাসটা তুলে নিয়েছিল।
কিন্তু বইয়ে মন বসল না। মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা খচখচ করছে। বাল্যকালের বন্ধুর এই ব্যবহারটা হঠাৎ করে মনের সব শান্তি কেড়ে নিয়েছে। ছুড়ে ফেলেছে বটে চিঠিটা, কিন্তু সেটা যেন টেবিলে চিৎ হয়ে পড়ে ইশারায় ডাকছে প্রিয়ব্রতকে।
প্রিয়ব্রত দড়াম করে বইটা বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে তুলে লাল প্রজাপতির ছাপ মারা ‘শুভবিবাহ’-র কার্ডটা এবং তিনটি বাক্য পড়া হতে না হতেই বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। শাঁখারিটোলা স্ট্রিটের চঞ্চল বসুর সঙ্গে তালতলা অ্যাভেনিউয়ের অরুণা রায়ের বিবাহের হার্দ্য আমন্ত্রণ ছড়িয়ে আছে সোনালি কার্ডে সিঁদুর রঙে ছাপা চিঠিটায়। ফের একটা বিদ্যুল্লতার আলোয় উদ্ভাসিত অরুণার জলে ভেজা মুখটা। আহা কী নিটোল, নিস্পাপ, আর্ত একটা মুখ। চোখের চাহনিতেই যেন একটু সাহায্য চাইছে।
কার্ডটা পুরো পড়া হল না প্রিয়ব্রতর, ও কার্ডটা ফের ছুড়ে ফেলল টেবিলে, তারপর টেবিলের দেরাজ থেকে এগারো পৃষ্ঠার প্রেমপত্রটা বার করে শেষবারের মতো পড়ল আর তারপর কুটিকুটি করে ছিড়ে দলা পাকিয়ে জানলার বাইরে ছুড়ে ফেলল। বহুদিন পর এক গভীর বিষণ্ণতা ভর করল মনে, প্রিয়ব্রতর মনে হল অরুণার সেদিন উচিত হয়নি ওর ছাতার নীচে এসে দাঁড়ানো। আর যদি বা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দাঁড়ালই, কী প্রয়োজন ছিল প্রিয়ব্রতর হাতটা অত স্পষ্ট করে ধরার? ওই স্পর্শ, ওই অন্ধকারে আগলে আগলে চলা, ওই একরত্তি সংলাপ ‘একটু দেরি হয়ে গেল’ যদি প্রেম না হয় তাহলে প্রেম কী? ওই বিদ্যুতের আলোয় একে অন্যকে দেখা যদি লাভ অ্যাট ফাস্ট সাইট না হয় তো প্রথম দর্শনের প্রেম আর কী হবে? অরুণা কী বুঝতে পারেনি যে ওই পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়ব্রত কতখানি বদলে গেছে?
টেবিল থেকে অরুণা বসুর চিঠিটা ফের তুলে নিল প্রিয়ব্রত। ও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না এই চিঠিটা পেয়ে ওর ভালো লাগছে না খারাপ লাগছে। তবু আরেকবার সেটা পড়ল ও, অরুণার হাতের লেখাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, তারপর কাজের লোক কাশীর নাম ধরে হাঁক দিল ‘কাশী! কাশী! কিন্তু এসে পড়তে ভুলে গেল আদৌ কেন ডেকেছিল ওকে। অগত্যা বলতে হল, না, এখন আর তোকে লাগছে না। ঘণ্টাখানেক পরে আরেকবার ঘুরে আসিস।
ঘণ্টাখানেক পর কাশী ঘুরে আসতে প্রিয়ব্রত ওকে একটা খাম তুলে দিল আর বলল, তালতলায় যেখানে দুর্গাপুজোটা হয় তার উলটোদিকে সতেরো নম্বর বাড়িতে এটা দিয়ে আয়। পারলে অরুণা দেবীর নাম ধরে জিজ্ঞেস করবি, তিনি থাকলে তাঁর হাতেই চিঠিটা দিবি। না হলে …
কাশী আর ওকে কথা শেষ করতে দিল না। ও ঠিক আছে, আমি বুঝে গেছি বলে কাঁধের গামছাটা একবার ঝেড়ে নিয়ে রওনা দিল। আর অরুণার আমন্ত্রণের প্রত্যাখ্যানপত্র হাতছুট হয়ে বেরিয়ে গেছে বুঝে ফের একটা কষ্টবোধ অনুভব করতে শুরু করল প্রিয়ব্রত। ওর ফাঁকা বাড়িটা সহসা আরও বেশি ফাঁকা মনে হতে লাগল।
অরুণাকে পাঠানো চিঠির এক জায়গায় বেশ নির্মম স্বরে প্রিয়ব্রত লিখেছে—আপনি যে প্রশ্নগুলোর কথা লিখেছেন তার উত্তর জানার ইচ্ছে হয়তো আমার আছে, কিন্তু এত দেরিতে জেনে কাজ কী? এ ছাড়া আমার সম্পর্কেও আপনার যেসব প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক সেগুলির উত্তর আমার কাছে নেই। যেমন, আমি জানি না আমি বিয়ে করলাম না কেন। কিংবা ব্যাচেলর জীবনে আমার খুব একলা লাগে কিনা। কিংবা আরও কঠিন প্রশ্ন—কেমন আছি? কী করে সময় কাটাই?