অরুণার সামনে বসে বুকের মধ্যে একটা ছোট্ট আন্দোলন অনুভব করেছিল প্রিয়ব্রত। তা কী প্রেম? তা কী প্রণয়? তা কী ভালোবাসার অনুভূতিটার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বেধ কিছুরই হদিশ করতে পারেনি প্রিয়ব্রত, তাই কিছুটা চুপ মেরেই বসেছিল। তারপর রাস্তায় আকাশ দেখতে দেখতে ভাবল, প্রেম কী ভাষা? না নৈঃশব্দ্য? প্রেমেও কী সময়-শৃঙ্খলা থাকতে হয়? ভালোবাসায় দেরি হয় কেন?
এইসব ভাবনার মধ্যেই একটা গাড়ি খানিকটা কাদাজল ছিটিয়ে দিয়ে গিয়েছিল ওর গায়ে, অন্ধকারে চশমার কাচ মুছতে মুছতে যখন ও বাড়ির দোরগোড়ায় এসে পৌঁছোল ওর মাথায় ততক্ষণে ভর করেছে এক ফরাসি কবির পঙক্তি, যেখানে কবি বলেছেন, একটা সেতু পার হতে হতেও তিনি একটু একটু বদলে যান। প্রিয়ব্রতর মনে হচ্ছিল, একটা বর্ষার সন্ধ্যায় ওয়েলিংটন পার্ক থেকে তালতলা হয়ে ক্রিক রো আসতে আসতেও ও কিছুটা বদলে গেছে। এত অল্প সময়ের মধ্যেও কী মানুষ এতখানি বদলে যায়? বদলাতে পারে?
অরুণা বসুর চিঠিটা ফের একবার হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল প্রিয়ব্রত। ভণিতা-টনিতা কিছু নেই, খুব স্বচ্ছ। স্বাভাবিকভাবে কয়েকটা কথা বলা আছে, কিন্তু সেই স্পষ্ট, স্বাভাবিক কথাগুলোই লক্ষ দ্যোতনা বহন করে আনছে প্রিয়ব্রতর মনের আনাচে কানাচে।
অরুণা লিখেছে—
প্রিয় অধ্যাপক মজুমদার,
জানি না আমাকে আপনার আর মনে আছে কিনা। যোলো বছর আগে এক সন্ধ্যায় আপনি আমাকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। তারপর আশায় আশায় ছিলাম আপনি ফের একদিন আসবেন। আসেননি। ইচ্ছে ছিল বিদেশ পাড়ি দেওয়ার আগে একবার অন্তত আপনার সঙ্গে দেখা করার। কেন যে সেটা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠল না আজ মনে নেই। আপনি জানতে চাইতেই পারেন যে যোলো বছরে এই আমার প্রথম দেশে আসা কিনা ; উত্তর হল, না। এই আসা পঞ্চম। জানতে চাইতেই পারেন আগের চারবার আপনার খোঁজ নিইনি কেন। আর এবারই বা কেন স্মরণ করলাম। এর সমস্ত উত্তরই আপনাকে দেব, যদি একবারটি আসেন।
ইতি
অরুণা বসু
প্রিয়ব্রতর মনে হল ষোলো বছর পর নতুন করে পুরোনো প্রশ্ন তোলার কোনো মানে থাকবে না। অরুণাকে দেখার জন্য যাওয়া নিশ্চয়ই যায়, তাই বলে পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে কার কী লাভ? সেই তো একই প্রশ্ন—কেমন আছেন? বিয়ে করলেন না কেন? একা লাগে না? কী করে সময় কাটান?—এর বাইরে কীই বা আর বলার আছে? প্রশ্নগুলো কয়েকবার মনের মধ্যে রগড়ে নিয়ে প্রিয়ব্রত চিৎ হয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়ল। আর খুব ক্লান্ত লাগল ওর।
প্রিয়ব্রতর মনে পড়ল বাড়ি ফিরে সেই সন্ধ্যায় ও দোতলায় সিঁড়ির মুখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেছিল এ এক ধরনের এপিলেপসি। বহুকাল শরীরে লুকিয়ে থেকে হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়েছে। মা বলেছিলেন ছেলের বেজায় তড়কা হত বাল্যে, কাঁপুনি দিয়ে মৃগীতে ধরত। তারপর একসময় কেটেও যায়। এ বোধ হয় সেই মৃগীরই নতুন উপদ্রব।
জ্ঞান হয়ে প্রিয়ব্রত প্রথম যে দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখে সেটি অরুণার মুখ, বৃষ্টিতে ধোওয়া, হঠাৎ বিদ্যুতের আলোয় ভেসে ওঠা। যদি প্রেমে পড়া বলতে সত্যিই কিছু হয়ে থাকে প্রিয়ব্রতর জীবনে তবে সেটা ঘটেছিল ওই মুহূর্তেই। কোথায় ভয়? কোথায় দ্বন্দ্ব? সব কীরকম মুছে গেল জ্ঞানে ফিরে সন্ধ্যার সেই অলৌকিক দৃশ্যটি মনে পড়ায়। পরদিন সকালে একটু সুস্থ হয়েই প্রিয়ব্রত জীবনের প্রথম প্রেমপত্রটি লেখে অরুণাকে।
এখনও মনে আছে প্রিয়ব্রতর যে এগারো পৃষ্ঠার চিঠিটা উত্তরোত্তর আবেগ ও প্যাশনে ছেয়ে গিয়েছিল এবং শেষ হয় একটা প্রচ্ছন্ন বিয়ের প্রস্তাবে। লেখা হয়ে যাওয়ার পর কতবার যে সেটি প্রিয়ব্রত পড়েছিল এবং কিছু শব্দের সংস্কার করেছিল বলা মুশকিল, কারণ সমস্তটাই ঘটেছিল কেমন একটা ঘোরের মধ্যে। শেষবার চিঠিটা পড়ার পর এবং শেষ সংশোধনটুকু করার পর যেন সংবিৎ ফিরে পায় প্রিয়ব্রত। ছি! ছি! মাত্র দু-আড়াই ঘণ্টার আলাপের পর কোনো মহিলাকে এ চিঠি লেখা যায়? বাগদত্তা কোনো মেয়ের কাছে এই প্রস্তাব রাখা যায়? প্রিয়ব্রতর হঠাৎই যেন নিজেকে খুব অচেনা লাগাতে শুরু করে। অরুণার হাতে হাত রেখে ওর পাশাপাশি ওইটুকু হাঁটাতেই একটা মানুষ এতখানি বদলে যেতে পারে? ফরাসি কবিটি কে যেন? পল ভালেরি? যিনি অনুভব করেছিলেন যে, একটা সেতু পার হতে হতেও তিনি যেন একটু একটু বদলে যান?
ঠিক তখনই ফের ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছিল, আর ভালো করে বৃষ্টি দেখার টানে প্রিয়ব্রত ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। দেখতে পেল দিগন্ত ছেয়ে বৃষ্টি হচ্ছে, যতদূর চোখ যায়। আর মনে পড়ে যায় ওর অপর প্রিয় ফরাসি কবি পল ভের্লেনের ক-টি পঙক্তি; ও আবৃত্তি শুরু করে—‘শহরের ওপর বৃষ্টি নেমেছে,/ বৃষ্টি পড়ছে সমস্ত বাড়ির ছাদের ওপর, /বৃষ্টি ঝরছে আমার হৃদয়ের ওপর।
ওই সময়ই প্রিয়ব্রত দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারায় এবং জ্ঞান ফিরে দেখে ও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। বন্ধু চঞ্চল ওকে দেখতে এসে বলেছিল ওর টেবিলে পড়ে থাকা চিঠিটা নিয়ে নাকি বাড়িতে বেজায় আলোচনা হয়েছে—মেয়েটি কে? কোথায় আলাপ প্রিয়র সঙ্গে? প্রিয় কি সত্যিই বিয়ে করতে চায়? তাহলে অ্যাদ্দিন ধরে সম্বন্ধ দেখাদেখি নিয়ে ওর এত