সঙ্গে সঙ্গে ওর কথার মধ্যে প্রিয়ব্রত ঢুকে পড়ল, ধন্যবাদ কেন? অন্ধকারে এই যে হাঁটা এবং ভেজার সঙ্গী পেলাম, এর ধন্যবাদটা…
-না, থাক। অ্যাই সামনে গর্ত, দেখে!
বলতে বলতে গর্তর পাশ থেকে হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিল প্রিয়ব্রতকে অরুণা।
প্রিয়ব্রত বলল, এবার কিন্তু আমায় বলতেই হচ্ছে ধন্যবাদ।
অরুণা বলল, বলুন, কিন্তু আমার হাতটাও ছাড়বেন না।
তারপর বাকি রাস্তা অরুণার হাতটা ছাড়েনি প্রিয়ব্রত। কথায় কথায় জানল অরুণা থাকে তালতলায়, ফলে প্রিয়ব্রতর ক্রিক রো পাড়ার কাছেই। জানল অরুণা ডাক্তারির ফাইনাল দিয়েছে হালে, পাস করে বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।
বিদেশে কেন? দেশে কি ডাক্তারির সুযোগ নেই? সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে বসেছে প্রিয়ব্রত।
বৃষ্টির ঝমঝমের মধ্যেও অরুণার হাসিটা শুনতে পেয়েছিল প্রিয়ব্রত—তা থাকবে না। কেন? তবু তো জানেন একটা বিলিতি তকমার এখনও কী মূল্য এদেশে।
প্রিয়ব্রত আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে বলেছিল, অ!।
তারপর বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হাঁটার পর অরুণা অনুভব করল ওর হাতের ওপর প্রিয়ব্রতর হাতের মৃদু চাপ। ও একটু কেঁপে উঠে বলেছিল, হ্যাঁ, কিছু বলছেন?
প্রিয়ব্রতর সরল প্রশ্ন তখন, আপনার নামটাই জানা হল না…
–অরুণা রায়। আপনার?
–প্রিয়ব্রত মজুমদার।
—বেশ নামটা আপনার, কবি কবি।
–কেন বলছেন?
–কেন আবার, কলেজে দর্শন পড়াই। যাকে বলে গনকেস।
প্রিয়ব্রত অনুভব করেছিল অরুণা আরও শক্ত করে ধরল ওর হাতটা, সহানুভূতি আর ভরসার ছোঁয়া তাতে। খুব আশ্বস্ত বোধ করেছিল ও, তাই আমতা আমতা করে জিজ্ঞেসও করে বসল, দর্শন আপনার অপছন্দ নয় তাহলে?
তখন বাস্তবিকই আন্তরিক শোনাল অরুণার কণ্ঠ, অপছন্দ মানে? আই অ্যাম ট্রলি ফণ্ড অব ফিলোজফি। ডাক্তারি পড়েছি বলে এতটা নীরেস ভাববেন না। আর কী জানেন? বহুদিন পর
একজন দর্শন-পড়া লোকের সঙ্গে পরিচয় হল।
প্রিয়ব্রত বলল, বেটার লেট দ্যান নেভার। তাই না?
অন্ধকারে ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে এক সুদূর কণ্ঠধ্বনিতে অরুণার উত্তর এল, একটু দেরি হল বই কী! মাস তিনেক।
হঠাৎ কীরকম শীত শীত করে উঠল প্রিয়ব্রতর। তিনমাস এতদিন দেরি করিয়ে দেয়। ওর হাত থেকে অরুণার হাতটা আপনা-আপনি খসে গেল। শুনল অরুণা বলছে, ওই আমার বাড়ি! আপনি কী একটু ভিতরে আসবেন? একটু কফি?
প্রিয়ব্রত তখনও দেরির ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেনি, কীরকম আনমনাভাবে বলেছিল, কফি? না, না, কফি না। এমনিই একটু আসতাম না হয়।
তবু বৈঠকখানায় বসিয়ে অরুণা নিজের হাতে কফি বানিয়ে এনে দিয়েছিল প্রিয়ব্রতকে। কাপটা হাতে তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেছিল, কী হল মশাই, মুডটা কীরকম বদলে গেল যেন?
কাপটা হাতে ধরে সেই আনমনাভাবেই বলেছিল প্রিয়ব্রত, বিয়েটা করেই তাহলে বিদেশে যাচ্ছেন?
প্রিয়ব্রতর মুখে সহসা ‘বিয়ে’ শব্দটা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল অরুণা, সেই ভাবটা কাটতে কিছুটা বিব্রতভাবে বলল, সেইরকমই তো কথা। তারপর প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য বলল, যাক সেসব কথা। আপনার কথা বলুন।
এবার প্রিয়ব্রতর অপ্রস্তুত হওয়ার পালা। এক চুমুক কফি খেয়ে গরম কাপে হাত সেঁক দিতে দিতে বলল, আমার আর কী কথা। কলেজ যাই, পড়াই। বাড়ি ফিরে বইয়ের পাতা ওলটাই, খাই-দাই, ঘুমোই।
অরুণার এবার স্পষ্ট প্রশ্ন, কেন বিয়ে করেননি?
আবার কফিতে চুমুক দিয়ে প্রিয়ব্রত বলল, কই আর হল!
-কেন, ইচ্ছে হয়নি?
–তা বলব না। ইচ্ছে হয়েছে, তবে একটু দেরিতে মনে হয়।
—দেরিতে? বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল?
—ঠিক তা না। বিদ্যুতের আলোয় একঝলক তাকে দেখে মনে হয়েছিল ওর কাছে যাই। কী জানি কেন মনে হল, এ-ই সে। সে আমার পাশে হাঁটা শুরু করাতে মনে হল, এই সেই সময়। আমার হাতে ওর হাত, মাথার ওপর দু-জনের একটাই ছাতা…মনে হল কাউকে যে কখনো এভাবে ভালো লাগেনি সেটাই মঙ্গল। … কিন্তু, কিন্তু আমার একটু দেরিই হয়ে গেল।
প্রিয়ব্রতর আর কিছু মনে পড়ে না সেদিনের সেই সন্ধ্যার। বিদ্যুৎচমক থেকে নিজের ওই সংলাপ অবধি অবশ্য সবটুকুই ওর মনে পড়ে সত্যজিতের ‘চারুলতা’ ছবির শেষ ক-টি দৃশ্যের মতো। আর বারবার সেই দৃশ্যগুলোই ফিরে ফিরে আসছে টেবিলের ওপর যত্ন করে মেলে রাখা চিঠিটার দিকে তাকালে।
চিঠিটা তালতলার অরুণা বসুর।
যোলো বছর আগে এরকমই এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় যে অরুণার—তখন রায়পাশাপাশি এক ছাতার তলায় হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়ব্রতর ধারণাটা বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, সব কিছুতেই ওর যেন একটু দেরি হয়ে যায়।
সেই সন্ধ্যায় অরুণাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওর মনে হয়েছিল, কেন জিজ্ঞেস করলাম না ও কি বাগদত্তা? বিয়ের আগে কত সম্বন্ধই তো দেখা হয়, সব কি পাকা হয়?
প্রিয়ব্রত রাস্তার মোড় অবধি গিয়ে ফিরেও এসেছিল, কিন্তু অরুণাদের বাড়ির কলিং-বেলে আঙুল রেখেও সেটা টিপল না। কী জিজ্ঞেস করা যায় অরুণাকে ঠিক এই সময়? একটা বিলেতমুখী পাত্রের থেকে মুখ ঘুরিয়ে একটা দর্শনের অধ্যাপকের সঙ্গে জোড় বাঁধার প্রস্তাব দেবে? এটা নাটক-নভেলে চলে যেতে পারে, তাই বলে বাস্তব জীবনে?
প্রিয়ব্রত ফের বাড়ির পথ ধরেছিল, যেতে যেতে একটা সিগারেট ধরিয়ে ট্রামরাস্তার পাশে দাঁড়াল। হঠাৎ করে ওর প্রিয় দার্শনিক লুডভিগ ভিটগেনস্টাইনের একটা কথা মনে পড়ে যেতে মাথার ওপর থেকে ছাতাটা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল ও। ভিটগেনস্টাইন ভাষার অক্ষমতার কথা বলেছিলেন। ওঁর গ্রন্থ ‘ত্রাক্তাতুস লোজকো-ফিলোজফিকুস’-এ বলেছিলেন, ভাষা দিয়ে নিখুঁত নৈপুণ্যে কিছুই বলে ফেলা যায় না। কাজেই যা ভাষায় পূর্ণ করে বলা যাবে নাসে-বিষয়ে নীরব থাকাটাই শ্রেয়। প্রিয়ব্রত মনে মনে ক-বার আউড়াল প্রিয় দার্শনিকের fez croit–‘Whereof one cannot speak, thereof one must be silent.’