—অথচ তোমাকে বলত এত সুন্দর শরীর শুধু একজনের ভোগে লাগা উচিত নয়।
ডরোথি এবার ওর সেই হা হা হি হি রুপোলি হাসিতে ভেঙে পড়ল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, দ্যাট টোনি ওয়াজ সাম ক্যারেক্টার। আমি এখনও ওকে বুঝিনি সত্যি।
অরুণ চুপচাপ খানিকক্ষণ স্মোক করল। সিগারেটটা শেষ করে নিভিয়ে ফের চুমুক দিল ড্রিঙ্কে, তারপর জিজ্ঞেস করল, আর কখন তোমার মনে হয় সিলভির সঙ্গে টোনির সে অর্থে কোনো প্রেম ছিল না?
ডরোথি এবার খুব দ্রুত উত্তর দিল, যখন তোমার দিদি শমিকে লেখা ওর চিঠিগুলোর কথা ভাবি।
ঘরের মধ্যে বাজ পড়ল যেন বিনা মেঘে। শমিকে লেখা টোনির প্রেমপত্র ডরোথি পড়েছে? তাতে কী ছিল? সে-সব ও পেলই বা কী করে?
অরুণ এসবের কিছুই জানে না। বাড়িতে কখন যে কী ঘটে গেছে কোনো আঁচ পায়নি ওই কিশোর বয়সে। শুধু মনে আছে এক রাতে দিদিকে বেদম প্রহার মা আর কাকা মিলে। থেকে থেকে কাকার প্রবল হুঙ্কার—কনভেন্টে পড়ে এই উপকার হল! বিলিতি শিক্ষার এই নমুনা। দুর করে দোব বাড়ির থেকে অপদার্থ মেয়ে কোথাকার!
পাশের ঘরে ভয়ে কান্নায় একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল অরুণ। কেন যে হঠাৎ দিদিকে নিয়ে এত হল্লা বাড়িতে তা বোঝার ফুরসত মেলেনি। তবে তার পর থেকেই দিদির ওবাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়েছিল। আর তার ক-দিন পর এক ঘটনা ঘটল যার কোনো মানে মাথা বুঝে পায়নি অরুণ সে সময়, আজ যেন তার কিছু খোলস ছাড়ানো যাচ্ছে। পাড়ার মাস্তান জগুদা হঠাৎ এক বিকেলে কাজফেরত সুককে ধরে বেদম ঠ্যাঙাল রাস্তার মাঝখানে। চুলের মুঠি ধরে চড়, দু-চারটে রদ্দা, তারপর গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ির ভেতর ফেলে দেওয়া। এই মারের সঙ্গে ইংরেজি বাংলা হিন্দি মিশিয়েও কত সব বকাঝকা চালাচ্ছিল জগুদা, যা বাড়ির ছাদ থেকে বিশেষ শুনতে পায়নি অরুণ। শোনার মধ্যে একটাই গাল—সোয়াইন।
তবে সেদিনও একটা ব্যাপারে বেশ অবাক হয়েছিল অরুণ। যা নিয়ে কখনো জিজ্ঞেস করেনি ডরোথিকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টোনির মার খাওয়া দেখল ও, কিন্তু প্রতিবাদ করল না। যা একেবারেই ওর সঙ্গে মেলে না।
অরুণ জিজ্ঞেস করল শেষে, শমিকে লেখা টোনির চিঠি তুমি পেলে কোত্থেকে?
ডরোথি বলল, টোনি চলে যাবার অনেকদিন পর শমিই এসে দিয়ে গেল চিঠিগুলো। বলল, এগুলো তোমার কাছে থাক, আমি অনেক চেষ্টা করেও পোড়াতে পারিনি। জিজ্ঞেস করেছি তোমরা কি সত্যি সত্যি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে ভেবেছিলে? শমি বলল—হ্যাঁ। ও ভীষণ, ভীষণ চাইছিল একটা সন্তান, যা তুমি ওকে দিতে পারনি। বললাম, কোথায় যেতে? শমি বলল—খুব দূরে কোথাও, যাতে আমার মা, কাকা, ভাইবোনদের কাছে আমার কোনো খবর কখনো না পৌঁছায়। যাতে ওরা ধরে নিতে পারে আমি মৃত। সেদিন আমি আর শমি দু-জনে দু-জনকে ধরে খুব কেঁদেছি। যাবার আগে শমি বলল, ডর, তোমার বন্ধুত্বের সম্মান আমি রাখতে পারিনি, আমায় ক্ষমা করো। আমি বলেছি, শমি, তুমি একটা ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়ে। আমি তোমায় অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। টোনির হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোর জন্যই ওকে ত্যাগ করেছি আমি।
অরুণের সব প্রশ্নই প্রায় শেষ হয়ে গেছে, বুঝতে পারছে না এরপর কী আর জিজ্ঞাস্য থাকে। তবু জিজ্ঞেস করল, মেয়েদের নিয়ে এই রোগের কথা কখনো জানতে চাওনি ওর কাছে? ডরোথি বলল, জানতে চাইনি আবার! শুধুই বলত, ইটস অল ইন দ্য ব্লাড। রক্তের দোষ।
-মানে।
-মানে বাবার থেকে পাওয়া।
—সেই বাবাকে নিয়ে জানতে চাওনি?
–বলত সব লেখা আছে, পরে পড়ে নিয়ো।
–পড়েছিলে?
—তখন দেয়নি। বলত দিস ইজ পার্সোনাল। আমাকে প্রমিস করিয়েছিল আমি কখনো ডায়েরি ছোঁব না। ছুঁইওনি।
—তাহলে যাবার সময় ফেলে গেল কেন?
—সেটাই ইন্টারেস্টিং। রাগারাগি করে অন্তত এক ডজন বার বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। প্রত্যেকবার সুটকেসে বাইবেল আর ডায়েরি সঙ্গে করে। শেষবার কিন্তু ডায়েরিটা ফেলেই গেল। ভেবেছিলাম ডায়েরির জন্যও যদি বা আসে। তবে…
কী মনে করে ডরোথির কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল অরুণ–পরে কবে পড়লে তাহলে?
উত্তর এল—শমির চিঠিগুলো পড়ার পর।
—তখন কী মনে হল?
—মনে হল কারও ডায়েরি নয়, যেন একটা উপন্যাসই পড়ছি। যে উপন্যাসে আমি নিজেও একটা চরিত্র।
—যেটুকু যা পড়েছি তাতে আমার নিজেরও তাই মনে হয়েছে।
–তাই না?
-আমি অবাক হয়ে গেছি ওর গল্প বলার ক্ষমতা দেখে।
—একেক সময় মনে হয় ও নিজের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে পেত।
–ও কবে শুরু করল এই ডায়েরি লেখা? মনে পড়ে?
—আমাদের আলাপের সময়ই দেখেছিলাম একটা খাতা ভরতি হয়ে আছে।
–এখন যখন ডায়েরিগুলো পড়া আছে কোন জায়গাগুলো তোমার সবচেয়ে পছন্দের?
—যে-জায়গাগুলো আমি কালো কালিতে কেটে তছনছ করেছি।
চমকে গিয়ে অরুণ বলল, সে কী! কোন জায়গা ওগুলো? আর কাটলেই বা কেন?
ডরোথি বলল, শমির সঙ্গে ওর অ্যাফেয়ারের জায়গাগুলো। ডায়েরির আর কোনো জায়গারই তুলনা হয় না তার সঙ্গে। দোজ প্লেসেজ ওয়্যার অলমোস্ট ডিভাইন। তুমি দেখতে পাচ্ছ টোনি যেন পুজো করছে শমিকে…ওরশিপিং হার, লিটেরালি ওরশিপিং শমি। আমার এত ভাল লেগেছিল, তবু মানতে পারিনি। শমিকে লেখা চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেললাম। পরে ডায়েরির ওই শেষ খন্ডটাও পোড়াতে গেছলাম। পারিনি। তাই কালি বুলিয়ে কথাগুলো নষ্ট করে দিলাম।