আমরা চা খেয়ে একটু চাঙা হয়েছি দেখেই প্রতাপ গুহ বলতে শুরু করলেন, এই বাড়িটাই আমার কাল হয়েছে। আমি এটাকে পুড়িয়ে ফেলতে চাই। আমাকে আপনারা সাহায্য করবেন!
আমরা? আমরা কী করে সাহায্য করব ওকে? উনি নিজেই তো সব পারেন। আমরা এই কথাটা মুখে উচ্চারণ করিনি। প্রতাপ গুহ নিজের থেকেই সেটা আঁচ করলেন, দেখুন আমি সবই পারি। আপনাদের খুন করা থেকে এই বাড়ি পোড়ানো অবধি সবই। কিন্তু আমি এমন কিছু করব না যার কোনো ব্যাখ্যা মানুষের কাছে থাকবে না! অথচ প্রতি ৭ আগস্ট তারিখে আমি আর এই বাড়িতে ফিরে আসতে পারছি না। বিলিভ মি, আই অ্যাম টায়ার্ড।
ওই ৭ আগস্ট তারিখটা ঝাঁ করে আমার মাথায় খেলে গেল। আরে হ্যাঁ আজই তো সেই ৭ আগস্ট! কিন্তু, এই তারিখটাই আমি কোথায় যেন দেখেছি সোনার জলে লেখা! আমি বার বার মাথা খুঁড়ে বার করার চেষ্টা করছিলাম! সেটা যখন বাপ্পা খুব নিস্পাপ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে বসল, ৭ আগস্ট কি আপনার মৃত্যুদিন? আর অমনি আমার মনে পড়ল প্রতাপ গুহর ছবির নীচে লেখা ছিল তারিখটা। তা হলে! তা হলে সত্যিই আমরা একটা অশরীরী আত্মার কবলে পড়লাম? আমি টের পেলাম আমার মাথা আর বেশিক্ষণ স্থির থাকবে না। যা করবার এখনই করা দরকার। আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম, আপনার জন্য যা যা করণীয় বলুন। আমরা করব। আমরা আর দেরি করতে পারব না। আমার দেখাদেখি দাঁড়িয়ে পড়ল বাপ্পা আর চন্দনও। ওদিকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতাপ গুহ বললেন, ওই ফায়ার প্লেস থেকে আগুন নিয়ে ঘরের পরদায় লাগান। তারপর ফার্নিচারে। আর দেখবেন আপনাদের মালপত্রগুলো বার করতে যেন ভুল না হয়।
বাপ্পা আমাদের লাগেজগুলো নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। আর আমি ওই ফায়ার প্লেসের জ্বলন্ত স্টিকগুলো দিয়ে ঘরের সমস্ত জিনিসে আগুন লাগাতে থাকলাম। চন্দনও কিছু স্টিক নিয়ে চলে গেল পাশের ঘরে। আর পিছনে ঝরনার দিকের ঘরের থেকে ভেসে আসতে থাকল প্রতাপ গুহর উদাত্ত কণ্ঠে গান,
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য করো,
এ জীবন পুণ্য করো দহন দানে, আগুনের …
আমরা জানি না কতক্ষণ এই ধ্বংসলীলায় মেতে থেকেছিলাম। সমস্ত বাড়িটাই যখন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আর ক্রমশ আগুনের শিখা পাশের পাইন গাছের সমান হয়ে উঠল তখন পূর্ব আকাশে সূর্যোদয়েরও প্রথম আভাস দেখা গেল। কী এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের তিনজনের কেউই জায়গা ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারলাম না। একটা অলৌকিক ঘটনাকে নিছক অলৌকিক বলে ছেড়ে দিতে মন সরল না। আমরা নিজেরাই গিয়ে দমকলে এবং পুলিশে খবর দিলাম। আর কারণ হিসেবে বললাম, ফায়ার প্লেসের আগুন কার্পেটে ছড়িয়ে পড়ে অগ্নিকান্ড বাঁধে।
কিন্তু পুলিশ আমাদের কথায় বিশ্বাস করল না। উলটে জানতে চাইল, আমরা এই অভিশপ্ত বাড়ির সন্ধান পেলাম কী করে। তখন বাধ্য হয়ে কবুল করলাম ট্যাক্সিতে প্রতাপ গুহর সঙ্গে পরিচয়ের কথা। আর অমনি কপালে চোখ চড়ে গেল পুলিশের দারোগার। বললেন, বলেন কী, ট্যাক্সিতে? একটা ডিপ ব্লু রঙের অ্যাম্বাসাডারে?
চন্দন বলল, হ্যাঁ।
দারোগা বললেন, বুঝেছি।
ভয়ংকর কৌতূহল জেগেছিল আমারও। জিজ্ঞেস করলাম, কেন বলুন তো? গাড়িটার রহস্য কী?
একটাই। দারোগা গম্ভীর মুখে দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বললেন, ‘রহস্য একটাই। ওই গাড়িতে প্রতাপ গুহ আর ওই ট্যাক্সি ড্রাইভার খুন হয়েছিলেন বছর বারো-তেরো আগে।
কোথায়?
এই শিলঙে ঢুকতে একটা সস্তা হোটেলের সামনে।
এবার চমকে উঠল চন্দন। কারণ একটা সস্তা হোটেল থেকে আগের দিন রুটি-মাংস কিনেছিল ও। এবার প্রশ্ন করল ও-ই, আচ্ছা, দোকানের মালিকের একটা চোখে কি গর্ত?
আর মুখে বসন্তের দাগ?
দারোগা ঘাড় নেড়ে বললেন, এগজ্যাক্টলি। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে? ও দোকানটা তো আর নেই।
আমাদের আর বৈজ্ঞানিক যুক্তি খোঁজার মানসিক অবস্থা ছিল না। আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না, আগের দিনের ট্যাক্সি ট্রিপ থেকে শুরু করে ওই অগ্নিকান্ড অবধি যাবতীয় ঘটনার কতখানি বাস্তব, কতখানি অলৌকিক।
আমাদের চোখের সামনে দারোগা খস খস করে কেস রিপোর্টে লিখলেন, এ কেস অব অ্যাক্সিডেন্টাল ফায়ার। অথচ আমাদের স্পষ্ট মনে পড়ছিল কীভাবে আমি আর চন্দন আগুনের কাঠি দিয়ে দিয়ে গোটা বাড়িতে আগুন ছড়িয়েছিলাম। কিন্তু বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অনর্থক হাজতবাসে আমাদের কারোরই কোনো আগ্রহ ছিল না। এ ছাড়া এও জানতাম যা দেখেছি যা জেনেছি তার কোনো কার্যকারণ ব্যাখ্যা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা কোনোদিন নেই।
সেই আশ্চর্য সন্ধ্যা
অঝোর বৃষ্টিতে হঠাৎ এক আকাশ-জমি আলোকরা বিদ্যুৎচমকে প্রিয়ব্রত প্রথম দেখেছিল অরুণাকে। অরুণা কোনোক্রমে ভিজে শাড়ির আঁচল দিয়ে আড়াল করছিল বুকে ধরা খানকতক বইকে। বই বাঁচাতে গিয়ে আঁচলটাকে ঘোমটা করে মাথাটা বাঁচাতে পারেনি। ছাতা হাতে প্রিয়ব্রতকে দেখে বুঝি-বা একটু আর্ত চোখেই তাকিয়েছিল। বিদ্যুৎ মিলিয়ে যেতে ফের সেই ঘোর অন্ধকার। কিন্তু প্রিয়ব্রত আর ইতস্তত করেনি, ও দ্রুত পায়ে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আসুন আমার ছাতার নীচে। কোন দিকে যাবেন?
ওয়েলিংটন পার্কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে প্রিয়ব্রতর এই দেড়খানা কথায় শরীরের সমস্ত ক্লান্তি নিমেষে উবে গিয়েছিল অরুণার। বিদ্যুতের আলোয় ও খেয়াল করেছিল যুবকের চশমার কাচ বেশ পুরু। ছাতার নীচে চলে এসে ও প্রথমে বলল, কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব!