এবার প্রতাপবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কোন ছবি বলুন তো? কোথায়? আমি আঙুল উঁচিয়ে দেখালাম ওই বইয়ের তাকটার দিকে। সবাই ঘুরে তাকাল তাকটার দিকে। কিন্তু সেখানে কোনো ছবি বা ছবির ফ্রেম দেখা গেল না। প্রতাপবাবু খুব আওয়াজ করে হেসে উঠলেন, বুঝেছি, ভাই বুঝেছি। এ বাড়ির চেহারা আর আসবাবপত্র দেখে আপনি ভৌতিক কান্ডকারখানা কল্পনা করতে শুরু করেছেন। তাই তো? তা হলে বলি শুনুন, ওই ভূত-ফুত একদম বাজে জিনিস। পৃথিবীর সমস্ত কিছুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হয়। এমনকী অস্বাভাবিক মৃত্যুরও। যদি কেউ কেবল ভয় পেয়েই হার্টফেল করে তারও তো কতকগুলো সিম্পটমস আছে। তাই না? মৃত্যুর প্রকারও যেমন বিবিধ তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও বিভিন্ন?
বাপ্পা আর চন্দন খুব মনোযোগ দিয়ে প্রতাপ গুহর কথা শুনছে আর সায় দিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের প্রসঙ্গে মনে বল পেয়ে কার্পেটে উঠে বসলাম আমিও। আমাকে দেখে প্রতাপবাবু বলে উঠলেন, এই তো, দেখুন তো কেমন সাহসী হয়ে গেলেন আপনি। নিন একটু চা খান। এই বলে প্রতাপবাবু তাঁর দশাসই মিলিটারি ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে সবাইকে দিলেন। তারপর নিজের চায়ে চুমুক দিয়ে পাইপ ধরালেন। আর বললেন, এই যে ছাইদানিটা। বাইরে থেকে বলপ্রয়োগ না করে এটাকে কি একচুলও নড়ানো সম্ভব?
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, না। কখনো না।
প্রতাপবাবু দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলেন, আর ওই যে লাইটের সুইচ। ওটাকে কাছে গিয়ে নিভিয়ে না দিলে কি ঘরের আলো নেভানো যায়?
আমরা সমস্বরে ফের বললাম, না। কখনো না।
আর ঠিক তখনই ঘরের সুইচটা খুট করে আপনা-আপনি অফ হয়ে গেল। উজ্জ্বল আলোকিত ঘরটা মুহূর্তের মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার হল। আর আমরা পরিষ্কার শুনতে পেলাম, কাঠের মেঝের উপর ভারী লোহার অ্যাশট্রেটা ঘড়ঘড়, খড়খড় শব্দ করে নিজেই চলে বেড়াচ্ছে। ঠিক তখনই দূরে দরজার কাছ থেকে ভেসে এল প্রতাপ গুহর কণ্ঠস্বর, আমার তরুণ বন্ধুরা, আমি একটু আগেই বলেছি প্রকৃতির সমস্ত ক্রিয়াকলাপেরই একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। এবার বলছি ওই সমস্ত বৈজ্ঞানিক সূত্রের আবার একটা ব্যতিক্রমও থাকে।
আমার শরীর হিম হতে শুরু করেছে ততক্ষণে। বুঝতে পারলাম অন্য দুই বন্ধুও নিশ্চয়ই ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ওই অন্ধকারের মধ্যেই হয় চন্দন কিংবা বাপ্পার হাতের স্পর্শ পেলাম হাঁটুর ওপর। তারপর ফিসফিস করে জড়ানো বাপ্পার কণ্ঠস্বর, পাবক, আমাদের পালাতে হবে। উঠে আয়।
বাপ্পা কথাটা যেভাবে আমার কানের কাছে বলেছিল তাতে দূরে দাঁড়ানো প্রতাপ গুহ কিংবা তাঁর বিদেহী আত্মার শোনার কথা নয়। কিন্তু তিনি শুনতে পেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল, এত রাতে কোথায় যাবেন, এই তো বেশ আশ্চর্য সাক্ষাৎ আমাদের।
ওঁর কথা শেষ হতেই দড়াম করে সজোরে বন্ধ হয়ে গেল বাড়ির বাইরে যাওয়ার দরজাটা। আর অমনি প্রাণপণ চিৎকার করে উঠল চন্দন, আপনি কী পেয়েছেন কী? দরজাটা খুলে দিন, আমরা এক্ষুণি বেরিয়ে যাব।
কিন্তু এবার কোনো শব্দ এল না। শুধু তিনটে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাসের আওয়াজে ঘর ভরে গেল। আর দূর থেকে ভেসে আসতে থাকল ঝরনার জলের আওয়াজ। আমরা আমাদের হৃৎপিন্ডের ধুকপুকুনি শুনতে পাচ্ছি তখন। আমি নিজেকে বোঝালাম, কোনোমতেই জ্ঞান হারাব না। হারালেই মৃত্যু।
এবার চন্দন ওর দেশলাইটা বার করে একটা কাঠি জ্বালাবার চেষ্টা করল। কিন্তু বারে বারে চেষ্টা করে একটাও কাঠি জ্বলল না। যখন বিরক্ত হয়ে ও দেশলাই ফের পকেটে খুঁজতে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে ওর আর আমাদের মাঝখানে একটা হাত উঠে এল। সেই হাতে একটা বিলিতি লাইটার। আর আমার কানের পাশ থেকে প্রতাপ গুহর গলা, এই নিন লাইট।
চন্দন ওর পকেটের একটা সিগারেট বার করে বাড়িয়ে দিল আমার দিকে, ধর পাবক। কিন্তু আমার হাত আর উঠল না। আমি শুধু ওই লাইটারের আলোয় দেখছি তাকের উপর পূর্বের দেখা প্রতাপ গুহর সেই ছবিটা। ওটা আবার জায়গামতো ফিরে এসেছে। প্রতাপ গুহ সেটা লক্ষ করে বললেন, আপনি ঠিকই দেখেছিলেন। ঘরে আলো না থাকলে ছবিটা দেখা যায়। কিন্তু আলো থাকলে চোখে পড়বে না।
আমার শরীরে যেটুকু শক্তি বাকি ছিল তার সবটুকু জড়ো করে এবার গর্জে বলে উঠলাম, প্রতাপবাবু, আপনি আলো জ্বালুন। আমাদের মারতে হয়, আলোতে মারুন আর না হলে এখান থেকে বার হয়ে যেতে দিন।
আমার কথার সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল প্রতাপ গুহর লাইটার। আর ওঁর কণ্ঠস্বর ভেসে এল। বাড়ির ভিতরের দিকের দরজার পাশ থেকে, এ বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি বলে পদার্থ নেই। এখানে আলো যা দেখছিলেন সেটা চোখের ভ্রম। অসুবিধে হলে ফায়ার-প্লেসের আগুনটা জ্বালিয়ে নিন।
চন্দন বলল, আমার দেশলাই ড্যাম্প। প্রতাপ গুহ বললেন, ফের চেষ্টা করুন। চন্দন ওর দেশলাইতে ফের কাঠি মারতে ফস করে জ্বলে উঠল সেটা! এবারে চন্দন অন্ধকারে ক্রমাগত দেশলাই জ্বালতে জ্বালতে পৌঁছে গেল ফায়ার প্লেসের সামনে! একটা কাঠি ছোঁয়াতেই জ্বলে উঠল বহুদিনের শুকনো, দাহ্য লকড়িগুলো। দূর থেকে প্রতাপ গুহর গলা ভেসে এল, বেশ! তারপর একটু থেমে বলল, আরেক রাউণ্ড চা হবে নাকি?
আমাদের তিনজনের মধ্যেই তখন মৃত্যুভয় সমান। কিন্তু তিনজনেই একই সঙ্গে বলে উঠলাম, দিন। ক্ষণিকের জন্য আমার মনে হল ওই সব ভূত-ফুত কিছু নয়। প্রতাপ গুহ আমাদের সম্মোহিত করেছেন। চায়ের গ্লাস হাতে নিতেই তার উষ্ণ অনুভূতি হাতের ভেতর দিয়ে শরীরের সর্বত্র পৌঁছে গেল! গন্ধ পেলাম পাইপের তামাকের। আবছা অন্ধকারে দেখলাম ধিকি ধিকি করে জ্বলছে প্রতাপ গুহর পাইপ।