গদগদ কণ্ঠে বাপ্পা বলে উঠল, কার্পেটের কী দরকার? একটা জায়গা পেলে আমরা আমাদের বেডিং পেতেই শুয়ে পড়ব।
ভদ্রলোক, অর্থাৎ প্রতাপ গুহ বললেন, ওঃ নো! কার্পেটটা আপনাদের দরকার হবে। এ ছাড়া ফায়ার প্লেসে একটা আগুনের বন্দোবস্তও করে দেব। বাট দি ওনলি প্রবেলম ইজ ব্যোমবাহাদুর এখন দেশে গেছে। আজকের রাতের খাওয়াটা বাইরে সারতে হবে।
তাতে কী আছে? তাতে কী আছে? বলে প্রচন্ড ভদ্রতায় প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। মনে মনে সেই সঙ্গে হিসেব করে নিলাম আমাদের হস্টেল খরচ কতখানি বাঁচল। তারপর মুখে বললাম, শিলঙে কোথাও নেমে রাতের ডিনার কিনে নিলেই হবে। সিটের ওদিক থেকে চন্দন বলে উঠল, তা হলে স্যার আপনার ডিনারটাও আমাদের কিনতে দেবেন। প্লিজ!
প্রতাপবাবু তাঁর পাশের কাচটা একটু নামিয়ে দেখলেন জল খানিকটা ধরেছে। তিনি কাচটা আরও নামিয়ে ফের তাঁর পাইপটা ধরালেন। একটা মস্ত ধোঁয়া ছেড়ে গভীর তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, না ভাই, আমার ডিনার আমার সঙ্গেই আছে।
এরপর আমরা বহুক্ষণ চুপ রইলাম। প্রতাপবাবুও নীরবে পাইপ খেতে থাকলেন। একসময় নিভে যাওয়ার পরেও ঠোঁটে আগলে রাখলেন তাঁর দামি পাইপ। মাঝে মাঝে তিনি নিজের মনে গুনগুন করে গাইছিলেন একটা বিলিতি সুর। শিলঙে ঢুকব ঢুকব করছি, তখন ড্রাইভার হঠাৎ একটা হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল, খাবার-দাবার কেনার থাকলে এখানেই কিনে নিন বাবুরা। এটা সস্তার জায়গা আছে।
ফের ওর মুখে ওই সস্তা কথাটা শুনে আমরা তিন বন্ধুই এবার নির্মল আনন্দে হেসে উঠলাম। চন্দন টাকা নিয়ে খাবার আনতে নেমে গেল। ড্রাইভার তার সেই লম্বা একটা বিড়ি ধরিয়ে কীরকম আপনমনেই বলে গেল, সবসময় কিন্তু সস্তা খুঁজলে বিপদ আছে। কোথায় কী গোলমাল হয়।
আমি স্পষ্ট নজর করলাম ড্রাইভারের এই উক্তিতে প্রতাপ গুহ কিছুটা চমকে উঠলেন। আমার মনে হল ড্রাইভারের কথাটা বিদ্রুপাত্মক এবং সেটা প্রতাপবাবুর ভালো লাগল না।
কথাটায় আমি আর বাপ্পা একটু কৌতুকই অনুভব করেছিলাম। তাই কেউ আর তেমন করে প্রতিবাদও করলাম না।
আমরা যখন শিলং পিকের অ্যাপ্রোচের রাস্তায় প্রতাপ গুহর বাড়ির সামনে পৌঁছোলাম তখন রীতিমতো অন্ধকার। কিন্তু বৃষ্টি থেমে গেছে। একটা নির্জন রাস্তার শেষ প্রান্তে বাড়িটা। বাড়ির মুখটায় পাইন গাছ। ঠিক যেমনটি প্রতাপবাবু গাড়িতে বলেছিলেন। ওই জমে আসা অন্ধকারের মধ্যেও দেখলাম বাড়িটা বেশ বনেদি চেহারার। যদিও খুবই পুরোনো। ডেক বারান্দাটা তো প্রায় খসেই পড়েছে। মস্ত মস্ত টর্চ জ্বেলে বাড়ির দিকে পা ফেলতেই কেন জানি না গা-টা একটু ছমছম করে উঠল। আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম প্রতাপবাবু ঠিক মতন হাঁটছেন না, কিছুটা যেন ভেসে ভেসে যাচ্ছেন উঁচু-নীচু জমির ওপর দিয়ে। চন্দন আর বাপ্পা সেটা দেখেনি। আমার তীব্র বাসনা হল দৌড়ে গিয়ে ট্যাক্সিটায় চেপে বসি। কিন্তু তখনই প্রায় মোড় ঘুরে ট্যাক্সিটা মিলিয়ে গেল পাইন গাছের সারির পিছনের অন্ধকারে।
নিরুপায় হয়ে সামনের দিকে হাঁটলাম। ঠিক করলাম চন্দন বা বাপ্পাকে কিছু বলব না। আমার চোখের ভুলও তো হতে পারে, বিশেষত এই অন্ধকারে।
ঘরের দরজায় যখন এসে পড়েছি স্পষ্ট শুনতে পেলাম কাছেই একটা ঝরনার জল গড়াচ্ছে ঝিরঝির, ঝিরঝির করে। আর ওই ঝরনার জলের শব্দেই কীরকম ভয়টা আমার উবে গেল। এবার দরজা খুলে প্রতাপবাবু বললেন, মশাইরা সামনের এই ঘরটার দখল নিন। আমার ঘর ওই ঝরনার দিকে।
আমি টর্চ ফেলে ফেলে দেখতে থাকলাম ঘরটার কীরকম জীর্ণ দশা। কিন্তু তাও বলব এক কাঁড়ি টাকা গুনে হোটেলে থাকার চেয়ে ঢের ভালো। প্রতাপবাবু এবার বাড়ির পিছনের দিকে গিয়ে আলোর মেন সুইচ অন করলেন। আর ঠিক ওইখান থেকেই চেঁচিয়ে বললেন, নিন, এবার ঘরের সুইচ অন করুন।
কিন্তু সুইচ কোথায়! অন্ধকারে টর্চ ফেলে ফেলে কেবল সুইচ হাতড়ে বেড়াচ্ছি। এইভাবে গোটা ঘরটা দু-পাক দেওয়া হয়ে গেল, কিন্তু কোথাও সুইচ খুঁজে পেলাম না। আমি চেঁচিয়ে বললাম, স্যার সুইচ খুঁজে তো পাচ্ছি না। বাড়ির ও প্রান্ত থেকে প্রতাপবাবুর আওয়াজ ভেসে এল, বাঁ-দিকের বইয়ের তাকের পিছনে দেখুন।
আমার এই হতভম্ব অবস্থা দেখে বাপ্পা আর চন্দন দু-জনেই আমায় খিঁচিয়ে উঠল, আরে, ছেলেটার কী হল? বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়িয়েও বইয়ের তাক খুঁজে পাচ্ছে না।
আসলে তখন টর্চের আলোয় তাকের উপরে স্পষ্ট দেখলাম একটা ছবি। ছবিটা প্রতাপ গুহর। তার নীচের ইংরেজিতে লেখা আছে জন্ম ২০ মে ১৯২২, মৃত্যু ২৭ আগস্ট ১৯৬৭! অর্থাৎ তেরো বছর আগে…
আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল। আমার মাথাটা মনে হল ঘাড় থেকে সরে যাচ্ছে। আমি কী একটা বললাম হয়তো চেঁচিয়েই…তারপর?
আমি চোখ মেললাম যখন তখন দেখি মাথার পাশে তিনটে মাথা ঝুঁকে আছে; চন্দন, বাপ্পা আর প্রতাপবাবুর। ঘর আলোয় ঝলমল করছে। আমি ঘাড় কাত করে দেখলাম, চমৎকার একটা পুরোনো কার্পেটের ওপর আমি শুয়ে আছি। প্রতাপবাবুই প্রথম প্রশ্ন করলেন, কী মশাই! কী হয়েছিল আপনার! একটা সামান্য সুইচ জ্বালতে গিয়ে ভিরমি খেয়ে পড়লেন?
বাপ্পা বলল, গল্পের বই বেশি পড়ার এফেক্ট। যখন-তখন যেখানে-সেখানে যা খুশি কল্পনা করে নেয়। চন্দন বলল, ও আসলে একটু নার্ভাস টাইপের। আমার মুখ দিয়ে শুধু বেরোল, কিন্তু ছবিটা?