হাজারো প্রশ্নের ওঠাপড়ার মধ্যে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল অরুণ।
৫.
এক বোতল অ্যারিস্টোক্র্যাট হুইস্কি আর দু-প্যাকেট বেনসন অ্যাণ্ড হেজেস সিগারেট নিয়ে গিয়েছিল ডরোথির জন্য। ডরোথি সেই হুইস্কিই সার্ভ করছে দু-জনের জন্য। ইতিমধ্যে ওর বোবাকালা কাজের মেয়ে বিন্দিয়া এসে ক-প্লেট ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানিয়ে দিয়ে গেছে টেবিলে। একটা প্যাকেট খুলে ডরোথির দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিয়েছে অরুণ। ডরোথি সিগারেট নিয়ে ওর হুইস্কির গেলাস তুলে বলল ‘চিয়ার্স!’
অরুণও ‘চিয়ার্স!’ বলার সঙ্গে সঙ্গে কেমন এক স্নিগ্ধ আনন্দে ভরে গেল ওর মনটা। ডরোথি সিগারেট ধরিয়ে হুট করে উঠে গিয়ে গ্রাম চালিয়ে দিয়ে বলল, ফর ওল্ড টাইমজ সেক। আর রেকর্ড থেকে ধ্বনি উছলে উঠে গোটা ঘরটাকে ভরিয়ে তুলল। সারাঘর জুড়ে ভাসতে লাগল ন্যাট কিং কোলের জলদগম্ভীর রোম্যান্টিক গলার ফ্যাসিনেশন’।
গ্রামের পাশে দাঁড়িয়ে গেলাসে প্রথম চুমুকটা দিতে দিতে ডরোথি বলল, টোনির সবচেয়ে প্রিয় গান।
অরুণ গেলাসে সিপ দিয়ে বলল, আমারও।
ডরোথি বলল, তা কি আমি জানি না?
অরুণ হাসতে হাসতে বলল, সবই জান দেখি। শুধু জানলে না বেচারা টোনিটা কোথায় হারিয়ে গেল।
ডরোথি যেন কথাটা শুনেও শুনল না। নিজের সোফায় এসে বসতে বসতে বলল, গ্রামটার যা দশা হয়েছিল। তাই ইলেকট্রিশিয়ান যুগলবাবুকে দিয়ে সারিয়ে সাফ করে ফের চালু করলাম। চল্লিশ টাকা গচ্চা গেল ঠিকই, তবু তোমাকে এখন গান শোনাতে পারছি। মনে হয় এক যুগ পরে এ ঘরে গান বাজছে। কী জানি সত্যি কতদিন!
এরপর দু-জনে চুপ করে ডুবে রইল ন্যাট কিং কোলের ফ্যাসিনেশন-এ। গানটা শেষ হতে হুইস্কিতে দ্বিতীয় সিপ দিতে দিতে উঠে গিয়ে গ্রামটা বন্ধ করে দিল ডরোথি। আর ফিরে এসে সোফায় বসল, সো? কীরকম বুঝলে টোনির লেখাগুলো?
প্রায় আপনা আপনি অরুণের মুখ গলে বেরিয়ে এল, ফ্যাসিনেটিং!
ওর তারিফে চমকে গেছে ডরোথি—বলছ? রিয়্যালি!
অরুণ বলল, অ্যাবসোলিউটলি ফ্যাসিনেটিং!
ডরোথি সহসা বুঝে উঠতে পারল না এরপর কী বলবে। শেষে খুব দ্বিধার স্বরে জিজ্ঞেস করল, ওটা দিয়ে কিছু করা যাবে ভাবছ?
অরুণ, এবার খুব সপ্রতিভ, কেন না? তবে তুমি যা ভাবছিলে তা-ই হবে। আমি ওগুলো নিয়ে কোনো নিউজপেপার ফিচার করছি না। খুব আলাদা গোছের একটা লাভ স্টোরি লিখব।
সঙ্গে সঙ্গে ‘ওয়াও!’ বলে চিৎকার করে উঠল ডরোথি আর কেঁদে ফেলল। হাতের গেলাস নামিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, অরু এখন তো টোনি বলতে আমার কাছে ওই ডায়েরিগুলোই আর রেকর্ড। তুমি জানো টিবি-র লেট স্টেজে আমি এখন?
একটা ঠাণ্ডা হাওয়া সোঁ সোঁ করে বইতে লাগল অরুণের শিরদাঁড়া দিয়ে। মুখে শুধু বলতে পারল, কী বলছ কী, ডর?
ডরোথি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, একটা সিগারেটও আমার খাওয়া বারণ, জান?
-তাহলে খাচ্ছ কেন?
—কারণ আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। এই যে তুমি বললে একটা লাভ স্টোরি লিখবে আমি সেই দিনটার জন্য অপেক্ষা করব। আই মিন ইট।
গলা ধরে এসেছিল অরুণের, তবু না বলে পারল না—কিন্তু আমি তো সেই প্রেমের গল্প লিখব বাংলায়, নট ইন ইংলিশ। তুমি কী করে পড়বে?
ডরোথি ফের হুইস্কিতে চুমুক সেরে বলল, কেন, তুমি এসে আমায় ট্রান্সলেট করে শুনিয়ে যাবে।
ফের এক প্রস্থ নিস্তব্ধতা ভর করল ঘরটায়। দু-জনে একটু একটু করে মদ আর ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেল। শেষে সন্ধের প্রথম সিগারেটটা ধরিয়ে নীরবতা ভাঙল অরুণ। জিজ্ঞেস করল, আমার গল্প হতে গেলে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তরও তোমায় দিতে হবে ডর? এগ্রিড?
—তাহলে বলো, টোনি কি সিলভির প্রেমে পড়েছিল?
প্রশ্নটায় ভালো রকম চমকে গেল ডরোথি। ফলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বেশ জড়তাভরা গলায় বলল, এর কোনো উত্তর হয় না, অরুণ। কখনো মনে হয় হ্যাঁ, কখনো মনে হয় না।
—কখনো হ্যাঁ মনে হয়?
—যখন ভাবি সিলভি যেদিন কলকাতা ছেড়ে পাকাঁপাকি ভাবে চলে গেল দিল্লির ইন্টারকনের ফ্লোর শো আর্টিস্ট হয়ে আর টোনিকে দেখতাম গুম মেরে বসে থাকতে।
-ওরা ফিজিক্যালি ইনভলভড ছিল মনে হয়?
–না, তা মনে হয় না।
–তাহলে ওই ইনফ্যাচুয়েশন, প্ৰেমান্ধতা কেন?
—কারণ ওর একটা বদ্ধ ধারণা জন্মেছিল সিলভি ওকে ভালোবাসে।
চকিতে অরুণের মনে পড়ল সেই পঙ্গপাল আক্রমণের দিনে ব্ৰেণ্ডার মুখে শোনা কথাটা। ও জিজ্ঞেস করল, সিলভি যে ওকে ভালোবাসে সেটা ওর মাথায় ঢুকল কেন?
ডরোথি বলল, আমার জন্য।
-তোমার জন্য! কেন?
—কারণ মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে যেটা ছেলেরা পারে না। নানা জায়গায়, নানা পার্টিতে দেখে আমি টের পেতাম যে, মেয়েটার ভেতর একটা সার্টেন রেসপেক্ট আছে টোনির জন্য। অন্যদের থেকে একটু আলাদা করে দেখত। যেটা আমার ভালো লাগত না, ভয় লাগত।
—আর সেটা টোনি বুঝত?
—হয়তো। নাহলে আমার সামনে সিলভির নাম নিতে গলা ভেঙে যেত কেন।
–বুঝলাম। আর?
—আরেকটা কথা কি জান? টোনি কোনোদিন ইজায়াস বার-এ সিলভির গান শুনতে যায়নি। কোনোদিন। একবার আমি খুব জোরাজুরি করেছিলাম, কিছুতেই রাজি হল না। উলটে ঢের বেশি পয়সা খরচা করে শেহরাজাড-এ স্যাণ্ডি হল্যাণ্ডের গান শোনাতে নিয়ে গেল।
–কারণ?
–কারণ ও যাকে মনে মনে অতখানি চায় সে সবার জন্য প্রেমের গান গাইছে সেটা সহ্য হবার নয়।