সকালে ঘুম ভাঙল যখন সুখীন্দরের তখন দুটো প্রকান্ড ষাঁড় সুন্দরকে টেনে-হেঁচড়ে টুকরো টুকরো করছে। সমস্ত চত্বরটা রক্তে ধুয়ে যাচ্ছে। সুন্দরের প্রাণপাখি অনেক আগেই পালিয়ে গেছে, কিন্তু ষাঁড় দুটো তখনও নিজেদের বল পরখ করে যাচ্ছে। শহরের লোকগুলো যে এত নিষ্ঠুর সুখীন্দর আগে জানতেন না। অন্তত দু-আড়াই হাজার লোক বিস্ফোরিত নেত্রে এই মরণ খেলা উপভোগ করছে। একটিবার ওই দৃশ্য দেখেই সুখীন্দরের মনে হল উনি আর বাঁচবেন না।
খানিক পরে গোটা প্রাসাদ জেনে গেল রানির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাঁর আর কিছুই মনে পড়ে না। স্বয়ং রাজাকেই তিনি আর চিনে উঠতে পারছেন না। রাগে, অনুশোচনায় কঠিন মনের মানুষ মোহন সিংয়ের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। সব কিছুর জন্যই নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। তিনি রাজবৈদ্যকে ডেকে পাঠাবার জন্য হুকুম দিলেন। রানির দাসীদের সবাইকে ওঁর ওপর ভালো নজর রাখতে বললেন। মাথা খারাপ হলে মানুষ কত কীই না করে বসে! সেদিন আর মোহন সিং ম্যাকিয়াভেলি পড়লেন না। সভার গাইয়েদের বললেন খুব করুণ করে সন্ত কবিরের দোঁহা গাইতে। ছোটোবেলায় মোহন সিংয়ের মা খুব কবিরের দোঁহা গাইতেন। আজ ফের নিজেকে ভারি উজবুক, ভারি ছেলেমানুষ মনে হতে লাগল রাজার।
রাজবৈদ্য রানিকে পরীক্ষা করে বুঝলেন ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন যদি ফের কাউকে রানির ভালোবাসা পেতে হয় তাহলে বেশ কল করতে হবে। ঠিক যে দৃশ্য থেকে রানির মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে সেখান থেকেই ফের পুরো ব্যাপারটা সাজিয়ে তুলতে হবে। বৈদ্য রাজাকে ডেকে এক অদ্ভুত পরামর্শ দিলেন। বললেন, শোনা যায় রানিমার একটু দুর্বলতা ছিল সুন্দর সিংয়ের জন্য। আপনাকে এখন থেকে ওর কাছে সুন্দর সিং সেজে
যাতায়াত করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ দেখছি না। এ রোগ তো ওষুধে যাবার নয়।
রাজা প্রথম প্রথম কথাটা শুনে থ মেরে গেলেন। তারপর অনেকক্ষণ ভাবলেন। অবশেষে ভাবতে ভাবতেই বললেন আচ্ছা দেখি।
গোঁফে ঝুলপিতে ছোঁয়া ছোঁয়া কলপ দিতে দিতে মোহন সিং নিজের মনেই হেসে ফেললেন। বিলিতি মেক-আপ ম্যান এসে সুন্দর সিংয়ের ছবি দেখে দেখে রাজাকে সুন্দর বানাচ্ছে দেখলে রানি সুখীন্দরও হাসি চাপতে পারবেন না। শেষে রাজা যখন সুন্দরের মতন পাগড়ি আর নাগরাই পরলেন মেক-আপ ম্যান রবার্টস ওয়ানডারফুল! ওয়ানডারফুল! বলে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। রাজাকে খুশি করার জন্য বলল, নাউ ইউ আর জাসট সুন্দর সিং। ইভন হিজ ড্যাডি উইল কল ইউ সন। রাজা খুশিই হলেন, ইংরেজিতে তারিফ শুনে। চট করে একটা মোহর বার করে রবার্টসকে দিলেন।
রাত্রে যখন মোহন সিং পাঁচিল দালান ডিঙিয়ে রানির কোঠায় যাচ্ছিলেন তখন ওঁর কেন জানি না মনে হল, এই জীবনটাই আসলে সুখের। যত রাজ্যের জাল মানুষ দিয়ে রাজ্য চলানোয় সত্যিই কোনো সুখ নেই। বরং বড়োরানির ছেলেকে সিংহাসনে বসিয়ে বাকি জীবনটা সুন্দর সেজে সুখীন্দরের সঙ্গে প্রেম করলে মন্দ হয় না। আবেগের বশে মোহন সিং গুনগুন করে পুরোনো প্রেমের কাওয়ালি গাইতে লাগলেন। আর ঠিক তখনই কী ভেবে উনি ওপরে চাইতে দেখলেন একটা মস্ত দড়ির জাল সড়সড় করে নেমে আসছে ওঁর শরীরের দিকে। তখন উনি এক হাতে একটা কার্নিশ চেপে ধরে আছেন। হাত ফসকালেই চল্লিশ ফুট নীচে বাগানের শিকের ওপর পড়বেন। ভয়ে চিৎকার করবেন, তারও উপায় নেই। লোকজন উঠে এসে ওঁকে এই অবস্থায় দেখলে কী বিশ্রী ব্যাপারই না হবে। রাজা চোখ বন্ধ করে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন। ওপরে জানালায় দাঁড়ানো রানি সুখীন্দর স্মিত হেসে ইশারায় রাজবৈদ্যকে ফাঁস শক্ত করতে নির্দেশ দিলেন।
সম্ভবত মিনিট দশেক ধস্তাধস্তি করে রাজা জালের মধ্যে অচৈতন্য হয়ে পড়লেন। বৈদ্য কাজ হাসিল করে রানির ঘরে গিয়ে বকশিশ নিলেন। সুন্দরের মৃত্যুর শোধ উঠেছে দেখে রানি খুশি হয়ে একটা জড়োয়ার সেট তুলে দিলেন বৈদ্যর হাতে। বৈদ্য বললেন, আপনি পাগলের অভিনয় ভালোই করেছিলেন। না-হলে রাজাকে এই বোকা বানিয়ে মারা কি সম্ভব ছিল?
দেখুন, আমরা বৈদ্যরা পয়সা পেলেই তোক মারতে পারি। তবে এভাবে জাল ফেলে কাউকে মারিনি। রাজ পরিবারের লোকদের বিষ খাইয়ে মারা তো আমাদের উপরি আয়ের একটা বড়ো রাস্তা। সেরকম টাকা পেলে আমরা পুরো গ্রামকে গ্রাম বিষ খাইয়ে মারতে পারি। লোকে ভাববে মহামারি হয়েছে। হেঁ হেঁ হেঁ!
বৈদ্যকে বিদায় করে রানি ওঁর প্রিয় পরিচারিকা বিহারী মেয়ে মতিয়াকে ডাকলেন। মতিয়া ঘরে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলেন, তোর রানি হতে ইচ্ছে করে? মতিয়া বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকল। রানি হওয়া? সে আবার কী কথা? রানি হতে কার না ইচ্ছে করে? কিন্তু করছে কে? মতিয়া লাজুক মেয়েটির মতোই ঘোমটা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রানি কাছে এসে ওর পিঠে হাত রাখলেন। বললেন, আমি সত্যিই তোকে রানি করে দেব। তুই রানি থাকবি, পাগলি রানি। কোনোদিন এই অন্দরমহল থেকে বেরোবি না। সবাই তোকে কুর্নিশ করবে। তোর গুপ্ত প্রেমিক দলবীরকে মাঝ রাতে তোর ঘরে ঢুকিয়ে আনবি। কিন্তু খবরদার! কেউ যেন টের না পায়। তাহলেই বড়োরানির ছেলে, যে ক-দিনের মধ্যেই রাজা হবে সে তোকে কোতল করবে। তুই কেবল হীরে জহরত পরে দিনের বেলা পাগলি সেজে ঘরের মধ্যে ঘুরবি। চারটে দাসী থাকবে, কারোকে তোর মুখ দেখতে দিবি না। বাকি জীবন তোর সুখে কাটবে। বল, রাজি তো?