কিছুই সত্যি দেখার নেই, সিলভিদের বসার ঘরটা এমনিই পড়ে আছে। না চলছে। রেডিয়োগ্রাম, না বসে কেউ কোনো সোফায়, না চলছে ফ্যানও। ঘরের ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো যেটা অরুণদের বাড়ির দিকে খোলে তা হাট করে খোলা। তা থেকে লোহার স্পাইরাল সিঁড়িটা দিব্যি নেমে এসেছে একতলায়, কিন্তু সে সিঁড়িও অলসভাবে ঘুমিয়ে আছে, তার কোনো ধাপিতেই কোনো বেড়ালও শুয়ে নেই। অরুণ জানালার গর্ত থেকে চোখ সরিয়ে আনতে যাচ্ছিল যখন ওর নজর টানল একটা সামান্য জিনিস রেডিয়োগ্রামের ওপর রাখা সুকের প্লেয়ার্স নাম্বার সিক্স সিগারেটের পঞ্চাশের কৌটো। গোল টিন, আজ সকালেই সুকের হাতে দেখেছে ও। হাতে মোটা ক্যাশ এলেই এরকম রকমারি বিলিতি সিগারেটের আবির্ভাব হয় সুকের হাতে, বুক পকেটে, সাইডপকেটে। শুধু রনসনের সিগারেট লাইটারটা একই থাকে। সেই লাইটারটাও, অরুণ দেখল, দিব্যি শোভা পাচ্ছে সিগারেটের টিনের পাশে।
অরুণের গলার কাছটা কীরকম ব্যথা-ব্যথা করতে লাগল, ও চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে ছাদের উলটোদিকের আলসেতে গিয়ে দাঁড়াল। দেখতে চাইল ডরোথিদের বাড়ির কী দশা। দেখল সেখানেও সেই একই হাল, রোববারের দুপুরে নিঝুম হয়ে আছে বাড়িটা। অরুণ। ভাবল ডরোথি নিশ্চয়ই চান সেরে সেজেগুঁজে গালে হাত দিয়ে বসে আছে ডাইনিং টেবিলে। তাহলে ওর কি গিয়ে ওর সঙ্গে আহ্লাদের লাঞ্চটা সেরে ফেলা উচিত না? বিশেষ করে যে মধ্যাহ্নভোজে ওর পোর্ক ভিন্দালু পদে হাতে খড়ি হবে?
পর্ক ভিন্দালুর কথাটা মনে আসাতে বেশ একটা টান বোধ হল অরুণের। আর তার পরেই কীরকম একটা ভয়মিশ্রিত দ্বিধা। কী করে জানাবে মেয়েটাকে যে অত ডাকাডাকিতেও সাড়া দেয়নি সুক। কিংবা ছাদ থেকে ও দেখেছে সুকের সিগারেট আর লাইটার পড়ে আছে সিলভিদের গ্রামের ওপর। এই ভয় ও দ্বিধায় ওর খিদেটাও একটু একটু করে মরে এল, ও মা-র কাছে গিয়ে দুপুরের খাওয়ার কথা বলল না। ওর চিলেকোঠার ঘরটাকেই গোঁসাঘর করল, তার মেঝেতে মাদুরের ওপর শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়ল।
ওর ঘুম ভাঙল দূর থেকে ভেসে আসা আবছা এক চিৎকারে—আগুন! আগুন!!
প্রথম প্রথম ওর মনে হয়েছিল স্বপ্নের মধ্যেই কিছু শুনেছে হয়তো। পরে প্যাট প্যাট করে বাইরে গোধূলির আকাশের দিকে চেয়ে স্পষ্ট শুনতে পেল ওই হল্লা। তখন ও ছুট্টে ছাদের ওপারে গিয়ে দেখল পাড়ার ছেলে, ছোকরা, বয়স্ক, সবাই নানা সাইজের বালতিতে জল নিয়ে ছুটছে ডরোথিদের বাড়ির ভেতর। মুহূর্তে বুকটা হিম হয়ে গেল অরুণের। ও ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল ডরোথিদের বাড়ি যাবে বলে। তাড়াহুড়োতে বার দুয়েক হোঁচট খেল ছাদের সিঁড়িতে, শেষে পৌঁছোল যখন ওপারের বাড়িতে লীলা শেষ। সুকের দামি জামাকাপড়ের স্কুপে কেরোসিন ঢেলে দেশলাইয়ের আগুন লাগিয়ে গোটা বাড়িটাই পুড়িয়ে ফেলার উপক্রম করেছিল ডরোথি। আগুনের শিখা যখন সিলিং ছোঁয় তখনই অকুস্থলে হাজির নাটের গুরু আঁতোয়ান সুক। প্রথমে এক হ্যাঁচকা টানে বউকে ফ্ল্যাটের বাইরে ফেলে ইলেকট্রিকের লাইনটা অফ করে ও। তারপর বাথরুম থেকে জল এনে ঢালা শুরু করে। এক বিচ্ছিরি অগ্নিকান্ডের বিরুদ্ধে একা লড়ছিল ও, তাও বেশ কিছুক্ষণ। কার্পেট চাপা দিয়ে এক কোণের আগুন চাপতে গিয়ে হাতও পোড়াল। তখনই নাকি ডরোথি চিৎকার জুড়ে দেয় ফায়ার! ফায়ার!!
ডরোথির ‘ফায়ার! ফায়ার!!’ চিৎকার পড়শিদের মুখে ‘আগুন! আগুন!!’ হয়ে ছড়াতে লাগলে বালতি বালতি জল আসা শুরু হল। কেউ জানতেও চাইল না আগুন ধরল কীভাবে অ্যাংলোদের ঘরদোরে, এ আর নতুন কী! কিন্তু সাধের ফ্ল্যাট আগুনে পুড়ছে, জলে ভাসছে দেখে হাউ হাউ কান্না ধরল ডরোথি। ঠিক তক্ষুনি সেখানে ভিড়ের একজন হয়ে এসে দাঁড়াল অরুণ।
আঁতোয়ান সুকের ডায়েরিতে ‘আমি আগুন নিয়ে খেলতে ভালোবাসি’ কথাটায় এতগুলো ছবি ও ঘটনা এসে গিয়েছে অরুণের ভাবনায়। আপনমনে কটা সিগারেট খেয়ে ফেলেছে কে। জানে। ফের একটা ধরাল ও, আর দেশলাইয়ের কাঠিটা বাইরে ছুঁড়তে গিয়ে খেয়াল করল আশপাশের আরও অনেক বাড়িরই আলো নিভে গেছে। একটা থমথমে অন্ধকার রাত মুড়ে ফেলেছে শহরটাকে, একটা ভারী মেঘ ঢেকে দিয়েছে এক ফালি চাঁদকেও।
অথচ অরুণের চোখে ঘুম নেই। সুকের ডায়েরি ওর ঘাড়ে ভূতের মতো চেপে বসেছে। সেখান থেকে ফের ওকে পড়া শুরু করতে হবে। ও ঘরে এসে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ফের পাতা ওলটাতে ওলটাতে এসে থেমে পড়ল ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৫-এ। পাতার মাথায়
সুকের নিজস্ব হেডলাইন ‘লোকাস্টস ব্রিংগ লাভ অ্যাণ্ড ফায়ার’। পঙ্গপাল নিয়ে এল প্রেম ও আগুন। সুক লিখেছে—
৪.
পঙ্গপালের ঢেউ বয়ে গেল মিন্টো রো-এর ওপর দিয়ে আজ। সাত সকালে ঘোর অন্ধকার, বাইবেলে যেমন দিনের বেলার অন্ধকারের কথা আছে এখানে ওখানে। ঠিক কোথায় বলতে পারব না। আমার তাতে অবিশ্যি অসুবিধে নেই, আমি তো একপ্রকার অন্ধকারেরই জীব। অন্ধকার আমার জন্য ভালো ব্যাপার-স্যাপার ঘটায়। বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে। আজও তাই, যদিও শেষটা গোলমেলে হয়ে গেল।
আকাশটা যখন কালো হয়ে গেল আমি অরুর গলার শব্দ পেলাম। আমার ওকে আজ বড়োই দরকার ডরোথিকে সামলানোর জন্য। ডর পর্ক ভিন্দালু করতে চায় শুনে বললাম, অরুকে খেতে বলো আজ। ওকে তো ভিন্দালু খাওয়ানোর কথা আছে। ডর রাজি হতেই সুযোগটা এসে গেল। সিলভি কালই বলেছিল রোববার সকালে ক্লাইভ একদিনের জন্য খড়গপুর যাবে ওর অসুস্থ মাকে দেখতে। সো দিস ইজ আ গ্র্যাণ্ড চান্স, আমি বুঝে গেছিলাম। সিলভিকে কিস্যু বলিনি, তাহলে ও চিল্লামিল্লি করত। জানি ও আমাকে পছন্দ করে, কিন্তু কোনো সুযোগ দেয়নি এতকাল। একটা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স তৈরি হয়ে যাচ্ছে আমার। আমার প্রিয়তমা ডরোথি ছাড়া এত ঝামেলায় কেউ ফেলেনি আমায়। অথচ সেক্সি এবং গ্ল্যামারাস সিলভি সম্পর্কে কী উদ্ভট ধারণা সবার। যেন তুড়ি দিলেই উঠে আসবে!