চকিতে নিজেকে সামলে নিয়ে ডরোথি বলেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো, তাই তো। তুমি নিশ্চয়ই এসো। পর্ক ভিন্দালু আমি তোমার কথা ভেবেই করতে চেয়েছি। প্লিজ কাম।
সুকদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে বাইরের সোনালি রোদে বেরিয়েও অরুণের কেন জানি না মনে হল পঙ্গপালের অন্ধকারটা যেন পাড়ার আকাশ ছেড়ে কখন ঢুকে পড়েছে এই অ্যাংলো দম্পতির ফ্ল্যাটে। ও এক ছুটে উলটো দিকে নিজেদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে বলা শুরু করল, মা, মা, আজ দুপুরে আমার নেমন্তন্ন ডরোথিদের বাড়িতে।
মা অবাক হয়ে বলল, সে আবার কী কথা! বাড়িতে মাংস হচ্ছে আর তুমি বাইরে খাবে?
অরুণ বলল, ওদের বাড়িতেও মাংস হচ্ছে, খুব স্টাইলের রান্না।
মা মুখ ভেটকে বললেন, ছাড় তো তোর স্টাইল, যত্তোসব শুয়োরের মাংস দিয়ে রান্না।
অরুণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। খানিক পর নীচু স্বরে বলল, তাহলে কী?
মাও একটু নরম হয়েছে ততক্ষণ। বলল, ঠিক আছে যাও, নেমন্তন্ন করেছে যখন। তোমার মাংসটা ওবেলার জন্য তুলে রাখবখন।
অরুণ মনে মনে মাকে থ্যাংক ইউ বলে স্নান করতে চলে গেল। জীবনে প্রথম পর্ক ভিন্দালু খাওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছে ভেতরে ভেতরে।
স্নান সেরে, গায়ে পাউডার ছড়িয়ে, লম্বা কোঁকড়া চুলে সামান্য পমেড ঘষে, পপলিনের শার্ট আর গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট চড়িয়ে কখন যে দিব্যি পৌঁছে গেছে ডরোথিদের বাসায় অরুণের সে খেয়ালও নেই। কিন্তু ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখল খাবারের মনোহরা গন্ধ চারদিকে মম’ করলেও ডরোথি সেই সকালের বাসি পোশাকেই বসে আছে ডাইনিং টেবিলের এক ধারে, গালে হাত আর চোখ দুটো বন্ধ। ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল, সেটা ঠেলে বসার ঘরেও একটু থমকেছিল অরুণ। কোনো সাড়া শব্দ নেই দেখে খাবারের জায়গায় ঢুকে ওই দৃশ্য। অরুণ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, হোয়াট হ্যাপেণ্ড, ডর?
ডরোথি চোখ মেলে অরুণকে দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। অরুণ দ্রুত ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রাখল, বলল—কাঁদছ কেন, বলো কী হয়েছে।
ডরোথি ওর মাথার ওপর রাখা অরুণের হাতটা দু-হাতে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, অরু, আমার ভয় করছে।
কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারল না অরুণ, জিজ্ঞেস করল, ভয়? কীসের ভয়? একটা থমথমে গলায় ডরোথি বলল, নিজেকে।
অরুণ তো আকাশ থেকে পড়েছে, নিজেকে! কেন?
—মনে হচ্ছে বাড়িটা জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যাই।
-কারণ?
–টোনি, ক্লাইভের ওই নির্লজ্জ বউটার সঙ্গে ফেঁসেছে।
–সে কে?
সিলভি।
অরুণের মাথায় কিছুতেই এল না এত ফাঁসাফাঁসির কথা উঠছে কেন। মোটে তো আধ ঘণ্টা, চল্লিশ মিনিটের দেরি। ও ডরোথিকে ঠাণ্ডা করার জন্য বলল, তুমি ওসব চিন্তা ছাড়ো। তুমি চান করে তৈরি হয়ে নাও, আমি টোনিকে ডেকে আনছি। আমার যেতে-আসতে পনেরো মিনিটও লাগবে না।
ক্লাইভদের বাড়ি যেতে যেতে কত অদ্ভুত দৃশ্য চোখে ভাসল অরুণের। ছাদের ঘরে ও পড়তে বসলেই কত নাচগান, হইহল্লার আওয়াজ ভেসে আসে ক্লাইভদের ফ্ল্যাট থেকে। মাঝে মাঝে চিলেকোঠার জানালা খুলে কিছু দৃশ্য দেখে অরুণ। হাতে মদের গেলাস নিয়ে নেচে চলেছে ক্লাইভ, সিলভি, জেমস, এস্থার, এডি, পার্সি, নোয়েল, রিচি, বেলিণ্ডা। এ এক মস্ত দল ওদের, যখনই দেখবে কীরকম পার্টির মেজাজে। বিশেষ করে সিলভির হাঁটাটাই তো নাচ। অরুণ শুনেছে ও নাকি ‘ইজায়াস’ বার-এ রোজ সন্ধেয় গান গাইতে যায়। আর ক্লাইভ যে কী করে সেও এক রহস্য। অত হ্যাণ্ডসাম, টিপটপ, ফুলবাবুটি অ্যাংলোদের মধ্যে আর কে আছে? সারাক্ষণ সিগারেট ফুকছে, শিস দিচ্ছে, মুখে বিলেত আমেরিকা ছাড়া কথা নেই। মেয়েদের নাকি চোখের মণি। সুককে পাওয়ার আগে ডরোথিরও নাকি ‘ক্রাশ ছিল ওর ওপর। তারপর হঠাৎ একদিন স্বর্গ থেকে সিলভিকে পেড়ে নিয়ে এল ক্লাইভ। এ সবই ডরোথির মুখে শোনা কথা। একেক সময় আপনমনে পাড়ার অ্যাংলোদের কীর্তিকলাপ শুনিয়ে যায় ডরোথি। আর অরুণ সেসব আরব্য রজনীর কাহিনির মতো গোগ্রাসে গেলে।
এখন মিন্টো লেনের ওই বাড়িটার দিকে যেতে যেতে আচমকা একটা ভাবনা এল অরুণের। আচ্ছা, সিলভি না হয় খুব সুন্দরী, দারুণ নাচে, গায়। তাবলে ক্লাইভের মতো অত হ্যাণ্ডস্যাম একটা বরকে ছেড়েও সুকের পাল্লায় পড়বে কেন? সুকের গায়ের রং সাহেবি ঠিক আছে। ওর চোখ জোড়া নীল—ঠিক আছে। ও এরোপ্লেনের মেন্টেন্যান্সে আছে—ঠিক আছে। সারাক্ষণ টাকায় টাকায় ওর পকেট ভারী থাকেনা, এইখানে এসে অরুণ একটু থমকে গেল। সিলভি তো টাকাপয়সা ভালোবাসেই, টাকা ওড়াতেও ভালোবাসে…তাই বলে টাকার জন্যে?…আর ডরোথির মতো বউ থাকতে সুক…? অরুণের সমস্ত ভাবনাচিন্তাগুলো কখন কীরকম তালগোল পাকিয়ে গেল। ওর চটকা ভাঙতে ভাঙতে দেখল ও ক্লাইভ, সিলভিদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
নতুন করে কোনো ভাবনা আসার আগেই অরুণ বেল টিপে দিয়েছে। তারপর দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কোনো সাড়া নেই।
ফের বেল টিপল অরুণ; কিন্তু সাড়া নেই।
ফের বেল, ফের সেই নিস্তব্ধতা।
অথচ ও জানে সুক এখানে আছে। একটু একটু করে ওর মধ্যে ডরোথির ভয়, দুঃখ, রাগগুলো ছড়াতে লাগল। ও হয়তো সেই রাগেই হঠাৎ বিকট চেঁচিয়ে উঠল—টোনি! তার খানিক পর ফের—টোনি! শেষে মরিয়া হয়ে শেষবারের মতো—সিলভি! কোনো ডাকেই কোনো সাড়া না পেয়ে এবার মনে মনে, নিঃশব্দে অ্যাংলোদের প্রিয় গালটা উচ্চারণ করল–বাস্টার্ড! আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছেই নিজে লজ্জায় পড়ে গেল। ও মাথা নীচু করে বেরিয়ে এল, কিন্তু ডরোথিদের বাড়ি গেল না। চুপি চুপি বাড়ি ফিরে চিলেকোঠায় ওর পড়ার ঘরে ফিরে বন্ধ জানলার একটা মাঝারি ফাটল দিয়ে চেয়ে রইল বাড়ির পিছনে সিলভিদের ফ্ল্যাটের দিকে।