‘পঙ্গপাল’ শব্দটা অরুণ এক-আধবার স্কুলের ভূগোল-টুগোলের বইতে পেয়েছে, তবে সে বস্তুটি আখেরে কী দাঁড়াতে পারে তার কোনো ধারণাই ছিল না। আর পঙ্গপাল মানে যে আসন্ন রাত তা আর কল্পনায় আসবে কোত্থেকে! ও ঘাড় উঁচিয়ে পাড়ার আকাশ জুড়ে বেড়ে চলা অন্ধকার দেখতে থাকল।
ক্রমে পাড়ার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত মিশমিশে কালো অন্ধকারে চাপা পড়ল, অরুণ শুনল কেশবদা বলছে, মানে মানে বাড়ি কাট বাপ। এ তো বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার!
সবার মতো অরুণও গুটি গুটি বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। কানে আসছিল পথচারীদের নীচু গলায় কথাবার্তা আর চড়াৎ চড়াৎ আওয়াজ। হয়তো ওই পঙ্গপাল পড়ার আওয়াজ আর তার মধ্যে হঠাৎ ইংরেজিতে একজনের গলা, দিজ আর লোকাস্টস! দে আর গোয়িং টু ভ্যানিশ সুন।
কণ্ঠস্বরটা ভুল হওয়ার নয়, তবু অরুণ জিজ্ঞেস করল, ইজ ইট টোনিং সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর, অফ কোর্স! হোয়াট আর ইউ ডুইং হিয়ার, অরু কালেক্টস লোকাস্টস?
অরুণ বলল, কালেক্ট করব কী, চোখে তো কিছু দেখতেই পাচ্ছি না। হঠাৎ সেই অন্ধকারে কোত্থেকে এসে আন্দাজে অরুণের একটা হাত ধরল সুক। বলল, ঘাবড়িয়ো না। এটা কয়েক মিনিটের ব্যাপার। লোকাস্ট চলে গেলেই সকাল আবার সকাল হয়ে যাবে।
অরুণ জিজ্ঞেস করল, তুমি আগে এভাবে লোকাস্ট দেখেছ?
অন্ধকারেই সুকের জবাব এল, হ্যাঁ, ছোটোবেলায়।
অরুণ জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
সুক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই আলো ফুটল পাড়ার পশ্চিমে। অরুণ আকাশের দিকে চেয়ে দেখল পঙ্গপাল বাহিনী ক্রমশ সরে যাচ্ছে পুবে, আর পশ্চিমে ক্রমশ আকাশ আর রোদ বেরিয়ে আসছে। রাস্তার দিকে চাইতে অরুণ দেখল শয়ে শয়ে মরা পঙ্গপাল পড়ে আছে। হঠাৎ একটা ওর গায়ে এসেও পড়ল, ও সেটা গা থেকে ঝাড়ার জন্য লাফ দিতে গোটা দুয়েক পড়ল সুকের গায়েও। সাহেব ওর পেটেন্ট করা বুলি ঝাড়ল, শিট! তারপর হাতের ক্যানভাস ব্যাগ দিয়ে এলোপাথাড়ি পিটতে লাগল নিজের হাতে পিঠে পায়ে। আর মুখে ক্রমাগত ওই স্ল্যাং—শিট! বাস্টার্ড! ফাঁক অফ!!
আলো ফুটতে দেখা গেল একটা-দুটো নয়, বেশ ক-টা পঙ্গপাল পড়েছে সুকের জামায়, মাথায়, ব্যাগে। তখন অরুণও জুটল সাহেবের গা ঝাড়তে। সেই ঝেড়ে ফেলা পোকা যেই যেই পড়তে থাকল মাটিতে সুক ওর ভারী ক্যানভাস শুয়ে তাদের পিষতে থাকল। আর মুখে সমানে সেই খিস্তি—শিট! বাস্টার্ড!…
গোটা পাড়ার আলো যখন পরিষ্কার হয়ে গেল সুক যেন একটু স্বাভাবিক হয়েছে। অরুণকে বলল, আজ রোববার, তোমার নিশ্চয়ই ছুটি। চলো, লেটস সেলিব্রেট!
অরুণ বুঝে পেল না কীসের সেলিব্রেশন। বলল, আজ কী? নিশ্চয়ই ডরোথির জন্মদিন নয়। ওর জন্মদিনটা আমি জানি।
ভেরি ক্লেভার! বলে অরুণের পিঠে একটা চাপড় দিল সুক। তারপর বলল, তাহলে আমারটাও জান নিশ্চয়ই।
অরুণ বলল, না। তবে এইটুকু জানি সেটা আজ নয়।
ব্রিলিয়ান্ট! বলল সুক। আসলে ডর চাইছে আমার চাকরিতে প্রমোশনটা সেলিব্রেশন করতে। কোয়ায়েটলি। নো হ্যাঙ্কি প্যাঙ্কি অর পার্টি থ্রোইং। আজ দুপুরে আমার গেস্ট শুধু তুমি।
আমি! শুধু আমি?—অরুণ বেশ তাজ্জব হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, জাস্ট ইউ। কারণ ডরোথি বলল তুমি নাকি কখনো পর্ক ভিন্দালু খাওনি। আজ ও ওটাই রাঁধছে আমাদের দুজনের জন্য। তুমি প্লিজ তোমার মাকে বলো আজ তুমি আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করছ।
অমনি অরুণ বাড়ির দিকে ঘুরছিল মাকে বলবে বলে, সুক ওর হাতটা চেপে ধরে বলল, দাঁড়াও! এখন না।
-কেন?
-তার আগে তুমি আমার সঙ্গে পর্ক, মশলা, জার্মান লোফ আর ওয়াইন শপিং-এ যাবে। রাজি?
অরুণ বিগলিত স্বরে বলেছিল, ওহ, অফ কোর্স!
তালতলা আর এন্টালি মার্কেট থেকে কেনা হল পোর্ক, হ্যাম, সসেজ, রুটি মাখন চিজ, চার রকমের ফল আর কিছু সবজি। তারপর হাঁটা শুরু হল শিয়ালদা-র দিকে। সেখানে লিকার শপ থেকে কেনা হল দু-বোতল রাম আর চার বোতল বিয়ার। কিন্তু ফের পাড়ার
মমাড়ে এসে সুক বলল, ডিয়র অরু, তুমি কি খুব বিরক্ত হবে যদি একটা কথা বলি?
অরুণ বলল, কথাটা না শুনে কী করে বুঝব বিরক্ত হব কি না? পানের দোকানের জগরুকে দিয়ে আমি জিনিসগুলো বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি শুধু ডরোথিকে বলো আমি মিন্টো লেনে ক্লাইভদের বাড়িতে যাচ্ছি। ও রান্না শুরু করে দিক, আমি ঠিক বারোটায় পৌঁছে যাচ্ছি।
অরুণ সুকের হাতে ঘড়িতে দেখল দশটা কুড়ি। জিজ্ঞেস করল, আর আমি? সুক বলল, ইউ বি দেয়ার অ্যাট টুয়েলভ থার্টি শার্প! অরুণ ‘ওকে’ বলে জগরুর সঙ্গে চলে গেল ডরোথির কাছে।
বেশ ভালোই চকচক করছিল ডরোথির চোখ দুটো জগরু যখন একে একে জিনিসগুলো নামাচ্ছে ওর সেন্টার টেবিলের ধারে। শেষ হতে ডরোথি ওকে দু-টাকা বকশিশ করে বিদেয় করে দিল। ডরোথি এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সো? ফাইন পার্টি হবে আজ, কিন্তু টোনি কোথায়?
অরুণ তৈরিই ছিল, বলল—ক্লাইভদের বাড়ি গেছে। বলেছে ঠিক বারোটায় চলে আসবে। ডরোথি একটা চাপা আওয়াজ তুলল ‘হুম’। আর ওর সুন্দর মুখটা হঠাৎ কালো হয়ে গেল। একটু পর স্বগতোক্তির মতো বলল, আবার ওই ছেমড়ি মাগিটার পাল্লায় পড়ল ইডিয়েটটা!
কিছু বুঝতে না পেরে অরুণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, শেষে আমতা আমতা করে বলল, আমাকে ও সাড়ে বারোটায় আসতে বলেছিল ডর।