ওই সকাল থেকেই সুক ডরোথি রবার্টসের ভ্যালেন্টাইন। অরুণ পাতা উলটে উলটে ক্রমশ একটাই জিনিসে এসে ধাক্কা খাচ্ছিল—এয়ারপোর্টের কাজ সেরে এয়ারলাইনের স্টাফ বাসে ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে এসে কখন একটা গাছতলায় এসে দাঁড়াচ্ছে সুক, আর ব্ল্যাকউড অ্যাণ্ড হজ-এর টাইপিস্ট ডরোথি কখন এসে পৌঁছচ্ছে এবং সেখান থেকে কোথায় কোথায় গিয়ে ওরা কী-কী পাগলামি করছে। এই সমস্ত পাগলামির শেষ হয় কখনো সুকের ওয়ান রুম ফ্ল্যাটে, কখনো ডরোথিদের বাড়ির প্রাচীন বিছানায়। এই বিছানায়—ডরোথির বক্তব্য
ওর বাবা ওর মায়ের কুমারীত্ব হরণ করেছিলেন। ডরোথি যখন পেটে এল ওঁরা চার্চে বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন। সারাপাড়া হামলে পড়েছিল গির্জায়, কিন্তু বর এমিল রবার্টস হাজির হননি। সেদিন সকালেই প্র্যাক্টিসের সময় তাঁর প্রিয় ঘোড়া ক্যাপ্টেন-কুক-এর স্যাডেল থেকে ছিটকে পড়ে কোমায় চলে যান। অবিবাহিত মা মরিন ওয়েলচ সিদ্ধান্ত নেন তাঁর মেয়ে মৃত পিতা এমিল রবার্টসের পদবিই বহন করবে।
অরুণের মনে পড়ল ডরোথি কথায় কথায় একদিন ওকে কী বলেছিল। বলেছিল, তুমি জান অরু, আমি জীবনে কোন জিনিস ভীষণ মিস করি? অরুণ যখন জিজ্ঞেস করেছিল, কী জিনিস, ডর? ও একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, বাবার সঙ্গে একটা ছবি। কিন্তু ঈশ্বর সেটা হয়তো চাননি। বাবার মুখ কখনো দেখলাম না। আর ওঁর স্মৃতি বলতে আমাদের ম্যান্টেলপিসে বাবার জকি-বেশে একটা হাসিখুশি ছবি। বাবা সেদিন ক্যালকাটা ডার্বি জিতেছিল অ্যাফ্রিকান কুইন-এ সওয়ার হয়ে।
সুকের ডায়েরি পড়তে পড়তে একটা জিনিস ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছিল অরুণের কাছে। তা হল নির্মম সত্যকে খুব সহজভাবে মেনে নেওয়ার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে সুকের, আর সেই নির্মম সত্যটাকে সরলভাবে লেখার। যেমন ডায়েরির দ্বিতীয় খন্ডেরই এক জায়গায় ও লিখছে :
আমি জানি ডরোথির মতো এত সংরক্ষণশীল মেয়েকে বিয়ে করার বিপদ আছে আমার। ও আর একশোটা অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান মেয়েদের মতো নয়। অথচ আমিও বিয়ে করে আদ্যোপান্ত পালটে যাওয়ার ছেলে নই। মেয়ে ব্যাপারটার আমার রুচি আছে, মেয়েদের জয় করতে, চেখে দেখতে, বিছানায় ফেলে আমোদ করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ডরোথি আমার বউ হলে আমি এসব ত্যাগ করব ভাবতেই পারি না। অথচ ডরোথিকে আমি চাই এবং বউ করেই। জানি এতে দু-দুটো জীবন নিয়ে খেলা করছি—ওর এবং আমার; কিন্তু আমি আগুন নিয়ে খেলতে ভালোবাসি।
জায়গাটা পড়া হতে অরুণ একটা সিগারেট ধরিয়ে ফ্ল্যাটের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রাত নেমেছে সারাশহর জুড়ে, দূরের অনেক বাড়িরই আলো নিভে গেছে, যেসব আলো নেভেনি তাদের কীরকম জোনাকির মতো ঠেকছে। আকাশ জুড়ে একটা গাঢ় নীল অন্ধকার, আর তার এক কোণে একটা ভাঙা চাঁদ। যেরকম চাঁদকে আঁতোয়ান সুকের ওপরতলার ভাড়াটে সিরিল বলত ‘অ্যাংলো মুন’। ওই ছেলেবেলাতেই কথাটা শুনে বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিল অরুণ, এক সন্ধেয় সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল সুককে, টোনি, অ্যাংলো চাঁদ বলে কি কিছু হয়?
কথাটা শোনামাত্র হো হো করে হেসে উঠেছিল সুক—নিশ্চয়ই সিরিলের কাছে শুনেছ কথাটা? রাইট? অরুণ মেনে নিয়েছিল—হ্যাঁ। তখন সুক বলল, এটা একটা মহৎ তত্ত্ব মহামান্য সিরিল ওয়াটসনের। অরুণ বলেছিল, তার মানে? আঁতোয়ান সুক একটা ফ্রেশ প্যাকেট ছিঁড়ে একটা ‘লাকি স্ট্রাইক’ ধরিয়ে বলেছিল, সিরিল বিশ্বাস করে এ পাড়ায় বাঙালি, পারসি, এমনকী বাঙালি খ্রিশ্চানদের থেকেও অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানরা সব কিছুতেই পুরোপুরি আলাদা। এতটাই আলাদা যে বাঙালিরা যে চাঁদ দেখে অ্যাংলোরা ঠিক সেই চাঁদ দেখে না। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের চাঁদও আলাদা—অন্তত সিরিল ওয়াটসন তাই বিশ্বাস করে। আর সেই চাঁদ হল অ্যাংলো চাঁদ।
এইসব ভাবতে ভাবতে অরুণ দূরের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে কী ভেবে নিজের মনে হাসল। ওর মনে পড়ল ছেলেবেলায় দেখা চাঁদ নয়, একটা অদ্ভুত সকালের কথা। যে সকালের একটা চরিত্র ডায়েরি লেখক আঁতোয়ান সুক।
৩.
একটা রবিবারের সকাল। বেশ চকচকে রোদের সকালও। রোদে কী একটা সোনালি আভা মিশেছে, যেমনটা মিশে থাকে শরতের আলোয়। তাহলে কি বর্ষা গিয়ে..? অতটা মনে পড়ে না অরুণের। শুধু মনে পড়ে পাড়ার ফটিক, সঞ্জীব, নীলু, ভুলু, ডোম্বল, ডম্বলরা দড়ির বারপোস্ট খাঁটিয়ে বল খেলার জন্য তৈরি হচ্ছে। একটু আগে বেনেদের রোয়াকে বসে কেশবদা এক প্রস্ত গেয়ে গেছে মানবেন্দ্রর ‘বারে বারে কে যেন ডাকে’ গানটা। অরুণরা বায়না ধরেছিল, কেশবদা, ও আমার চন্দ্রমল্লিকা ধরো। কেশবদা এক টিপ নস্যি নাকে ঠুসে বলল, দূর! দূর! এই ভর সক্কালে কেউ রাতের গান গায়। বলে ধুতির কোঁচা সামলে উঠতে যাচ্ছিল, যখন কী আশ্চর্যের কারণে একটু একটু করে অন্ধকার ছড়াতে লাগল।
আর সবার মতো কেশবদাও আকাশের দিকে হাঁ করে চাইল, আর দেখল একটা জমাট অন্ধকার পাড়ার পশ্চিম কোণ থেকে মেট্রোপলিটান স্কুল পেরিয়ে পুবে মৌলালির দিকে ধেয়ে আসছে। এ আবার কী সূর্যগ্রহণ বাবা, ভাবল সবাই। কিন্তু ভাবনার আগে রাত ছুটছে, সোনালি রোদ গিলছে হাঘরে অন্ধকার। আর থেকে থেকে কীসব আছড়ে পড়ছে পিচের রাস্তায়, সিমেন্টের ফুটপাতে, রাস্তার এধার-ওধারের বাড়ির বারান্দায়। শেষে কোত্থেকে একটা শোর উঠল ‘পঙ্গপাল। পঙ্গপাল!