বারে দশেকের চেষ্টাতেও প্লেন ছাড়ল না। ডরোথিদের বাড়ির সামনেকার ওই উঠোনটায় গোটা সকালই কাটছিল এইভাবে, হঠাৎ ডরোথির উদয়। বরের থেকে একটা সিগারেট চাইতে এসে ওই দৃশ্য দেখে বলে উঠল, সেই অচল প্লেন! এবার কার সর্বনাশ করবে?
কথাটা খুব মনে ধরেছিল অরুণের। সেদিন সন্ধেয় সুক রাম কিনতে বেরোতেই সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে জিজ্ঞেস করল ডরোথিকে, ডর, সকালে কী একটা বললে যেন অচল প্লেন নিয়ে? এনিথিং ইনটারেস্টিং?
ওহ ইয়েস! ওহ ইয়েস, অফকোর্স! বলে খুব একপ্রস্থ হেসে নিল ডরোথি। তারপর যোগ করল, ওরকম একটা অ্যাবানডানড প্লেনে আমায় প্রথম কিস করে এই রাস্কেলটা!
সুককে নিয়ে খুব সোহাগ করে কথা বললে ওকে রাস্কেল বলে উল্লেখ করে ডরোথি। তাই জিজ্ঞেস করল অরুণ, প্রথম চুমুটা খুব খারাপ লাগেনি নিশ্চয়ই? ডরোথি তখন ওর ওই পেটেন্ট হাহা হিহি হাসিটা হেসে বলেছিল, টোনির ওই ডায়েরিতে কোথাও লেখা আছে। আমি পড়েছি। পারলে পোড়ো কখনো, তবে বড় হয়ে। টোনির সবকিছুই তো খুব অ্যাডাল্ট ব্যাপার,?
আজ মনে হয় ওই অ্যাডাল্ট ব্যাপার দিয়েই শুরু করা যায়—এই ভেবে অরুণ সামনের তাক থেকে রেক্সিনে বাঁধানো পাঁচটা লাল ডায়েরির প্রথম খন্ডটা তুলে নিয়ে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসল। কত কী যে পাগলটা লিখে গেছে এন্তার, রোমাঞ্চের শেষ নেই, কিন্তু কোথায় ডরোথি, তার নামগন্ধই কোথাও নেই! এর মধ্যে মায়ের পাশে শুয়ে সেই প্রস্টিটিউট কথাটা শোনাও এসে পড়ল, কিন্তু সেটা পরে পড়বে বলে পাতা উলটে গেল অরুণ। আর ওলটাতে ওলটাতে খেয়াল হল যে, ওর হাতে ধরা ডায়েরির খন্ডটায় সুক কলকাতাতেই এসে পৌঁছায়নি। গোয়া আর বম্বে করতে করতেই শেষ হয়ে গেছে।
অরুণ উঠে প্রথমটা জায়গামতন রেখে দ্বিতীয় খন্ডটা খুলতেই পুলকিত বিস্ময়ে অবশ হয়ে গেল। ডায়েরিটা শুরু হচ্ছে এভাবে—’ডরোথিকে পাচ্ছি, আমার জীবন শুরু হচ্ছে!’ অরুণ পড়তে শুরু করে দেখল এক অদ্ভুত রস, ছেনালি আর সরলতা মিশিয়ে সুক লিখে গেছে ডর বৃত্তান্তগুলো, যার কোথাও কোথাও কিছুটা স্বীকারোক্তির গন্ধও মিশে আছে। ডরোথিকে পাওয়ার প্রসঙ্গে যেমন লিখছে
আমি বাপু পোড় খাওয়া পার্টি, কোন মেয়ে উঠবে আর কোন মেয়ে বহুত হ্যাপা দেবে দিব্যি বুঝি। কলকাতায় এসেছি এই ছ-মাস, তার মধ্যে তিন তিনটে চিড়িয়া গেঁথেছি। ইভা, ট্রেসি, লাভলি। লাভলি খ্রিশ্চান নয়, কিন্তু এরই মধ্যে পালিয়ে আমাকে বিয়ে করার জন্য খেপেছে। কিন্তু আমার ভয় করছে ওদের কমিউনিটিকে, কোথাও কিছু ইধর-উধর হলে আমাকে পেঁদিয়ে লাশ করে দেবে। ইভা, ট্রেসিকে নিয়ে ভাবি না, দে আর ওনলি ফর দ্য গুড টাইমজ। আমারও তো গুড টাইমজ চাই, চার-পাঁচ পেগ রাম সেঁটে ট্যাক্সিতে চড়লেই তো আমার হাত দুটো কাজ শুরু করে দেয়। হাজার হোক, এয়ারক্রাফট মেন্টেন্যান্স মেকানিকের হাত তো। নাটবল্ট খুঁজতে বেশি সময় নেয় না; তার ওপর হাতের মধ্যে দুটো রক্তমাংসের বল এলে তার ফিলিং। ওহ ক্রাইস্ট, প্লেনের কোনো কলকবজাই তুলনায় আসতে পারে না। কিন্তু এখানেই একটা মস্ত বড়ো কিন্তু নেভিলদের ক্রিসমাস পার্টিতে আলাপের পর এগারো বার ডেট করা হল, কিন্তু একবারটিও মুখটা দুহাতে ধরে ঠোঁটে চুমু দেওয়া ঘটল না! হোয়াটস হ্যাপেনড টু ইউ, টোনি সুক? তোমার বম্বের সাঙ্গোপাঙ্গরা তো বিশ্বাস করবে না তুমি এগারো দিন ধরে ডেট করেও বিলকুল সুখা যাচ্ছ!
কাজেই সব মহৎ প্রেমের মতো এখানেও আমাকে একটা প্যাঁচ কষতে হয়েছে। আমি ফাঁদ পেতেছি ডরোথির জন্য। ওর খুব কৌতূহল প্লেন নিয়ে আমার কাজ কারবার বিষয়ে। সেদিন বেমালুম বানিয়ে বানিয়ে বললাম, আগামী ফোর্টিন্থ ফেব্রুয়ারি আমার জন্মদিন, সেদিন তোমায় একটা স্পেশ্যাল ট্রিট দিতে চাই।
ও আকাশ থেকে পড়ে চোখ দুটো আলুর মতো গোল করে বলল, তু-তুমি ভ্যা-ভ্যা ভ্যালেন্টাইনজ ডে-তে জন্মেছ! ভ্যালেন্টাইন ডে-টা যে কী, আমি কিছুই জানি না। একটা লিয়েন পাওনা ছিল, সেটা শুক্কুরবার দেখে ওই তারিখটায় নিয়েছিলাম। ডরোথি অমন করছে। দেখে জিজ্ঞেস করলাম, হোয়াটস সো গ্রেট অ্যাবাউট ভ্যালেন্টাইনজ ডে?
ডরোথি ফের অবাক হয়ে গেল—তুমি জানো না ওটা প্রেমিকদের দিন? তখন মোক্ষম চালটা চাললাম—তাতে আর কী লাভটা হল জীবনে? জন্মানোই সার হল, প্রেম কোথায়? ডরোথি তখন সেই অপূর্ব রূপোলি হাসিটা হেসে বলল, লায়ার! ড্যাম লায়ার! মিথুক কোথাকার। তখনই বুঝলাম আমার ফাঁদ পাতা কাজে এসেছে।
বাপরে! বলে একটা কাচের পেপারওয়েটে পাতাটা চাপা দিয়ে একটা সিগারেট ধরাতে উঠল অরুণ। লেখার মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার সুকের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে ও। বানানের ছিরি, গ্রামারের গড়বড় আর সিন্ট্যাক্সের রকমসকম ভেদ করে অদ্ভুত একটা স্বাদ উতরে আসছে। কাহিনি শোনানোর কিছুটা চপল, কিছুটা উন্মাদ একটা পদ্ধতিও আছে লোকটার। সুকের জীবনের যতখানি যা চাক্ষুষ করেছিল অরুণ ও তার সঙ্গে মিলিয়ে পড়া শুরু করল ফের। ডায়েরির উত্তম পুরুষেরা কখন যেন কোথায় হারিয়ে গেল, যেভাবে হয়তো সুককে নিয়ে ওর উপন্যাসে লেখা যাবে সেভাবেই ডায়েরির মধ্যে কাহিনির খোঁজে ঢুকে পড়ল অরুণ। আস্তে আস্তে সেই ভ্যালেন্টাইনজ ডে-তে আঁতোয়ান সুক ও ডরোথি রবার্টের প্রথম মিলনের বৃত্তান্তে কুঁদ হয়ে গেল ও।