সুধাকান্তবাবু গল্পে ফিরে গেলেন।
এক সময় গল্প শেষ হল। সুধাকান্তবাবু বললেন, খিচুড়ি নেমে গেছে। আপনাদের কি এখন দিয়ে দেব? রাত মন্দ হয় নি কিন্তু।
মিসির আলি বললেন, জ্বি, খেয়ে নেব। আপনাকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি।
জিজ্ঞেস করুন।
মেয়েটি শুধু কামড়ে ধরল-হাত দিয়ে আপনাকে ধরল না কেন?
আমি কী করে বলব বলুন। আমার পক্ষে তো জানা সম্ভব না।
আমার কিন্তু মনে হয় আপনি জানেন।
সুধাকান্তবাবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
মিসির আলি বললেন, আপনার গল্পের সবচেয়ে দুর্বল অংশ মেয়েটির কামড়ে-ধরা। মেয়েটি কিন্তু পেছন থেকে আপনাকে কামড়ে ধরে নি। পায়ের দাগ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কামড়ে ধরেছে সামনে থেকে আপনার দাগ ভালোভাবে পরীক্ষা করলেই তা বোঝা যায়। আপনাকে আক্রমণ করবার জন্যে মেয়েটি তার হাত ব্যবহার করে নি। কারণ একটাই—সম্ভবত তার হাত পেছন থেকে বাঁধা ছিল। তাই নয় কি?
সুধাকান্তবাবুর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। একটি কথাও বললেন না।
মিসির আলি বললেন, আপনার গল্পে একটা কুকুর আছে। পাগলা কুকুর। হাইড্রোফোবিয়ার কুকুর কিছুই খায় না। অসহ্য যন্ত্রণায় মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে। অথচ এই কুকুরটা আস্ত একটি মেয়েকে খেয়ে ফেলল, পাঁচটা সুস্থ কুকুরের পক্ষেও যা সম্ভব নয়। আপনি অসাধারণ একটা ভূতের গল্প তৈরি করেছেন। কিন্তু গল্পে অনেক ফাঁক রয়ে গেছে, তাই না?
সুধাকান্ত বিড়বিড় করে কী-যেন বললেন। আমি কাঠ হয়ে বসে রইলাম। কী শুনছি। এ-সব মিসির আলি লোকটি এ-সব কী বলছে।
মিসির আলি বললেন, ব্যাপারটা কী হয়েছিল আমি বলি। আপনি চিরকুমার একজন মানুষ। আপনার মনে আছে অবদমিত কামনা-বাসনা। মহাপুরুষরাও কামনাবাসনার ঊর্ধ্বে নন। কীভাবে যেন আপনি অল্পবয়সী একজন কিশোরীকে আপনার ঘরে নিয়ে এলেন। এই মেয়েটি কীভাবে এল বুঝতে পারছিনা। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসতে পারে, বা অন্য কিছুও হতে পারে। এই অংশটা আমার কাছে পরিষ্কার না। …
যাই হোক, মেয়েটিকে আপনার ঘরে নিয়েই আপনি তার হাত বেঁধে ফেললেন। মেয়েটির চিৎকার, কান্নাকাটি আশেপাশের কেউ শুনল না। কারণ আশেপাশে শোনার মতো কেউ নেই। মেয়েটি নিজেকে রক্ষা করবার জন্যে আপনাকে কামড়ে ধরল। এই একটি অস্ত্ৰই তার কাছে ছিল। …
অবশ্যি মেয়েটি নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। শেষ পর্যন্ত মারা গেল।…
আপনি তার মৃতদেহ ঘরেই ফেলে রাখলেন। দরজা-জানোলা খুলে রাখলেন, যাতে শেয়াল-কুকুর শবদেহটা খেয়ে ফেলতে পারে। এক দিনে তো একটা মানুষ শেয়ালকুকুরে খেয়ে ফেলতে পারে না। হয়তো দু দিন বা তিন দিন লাগল। এই সময়টা আপনি নষ্ট করলেন না, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলেন। ভেবে-ভেবে অসাধারণ একটা গল্প তৈরি করলেন। সেই গল্পে সূত্র আছে, কুকুর আছে, অশরীরী আত্মীয়রা আছে। কি সুধাকান্তবাবু, আমি ঠিক বলি নি? দিন, এখন খাবার দিয়ে দিন—প্ৰচণ্ড খিদে পেয়েছে। খেয়ে নেব।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম সত্যি-সত্যি মিসির আলি খেতে বসেছেন। সুধাকান্তবাবু তাঁকে থালা এগিয়ে দিচ্ছেন। মিসির আলি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি খবেন না?
আমি বললাম, না, আমার খিদে নেই।
মিসির আলি খেতে-খেতে বললেন, সুধাকান্তবাবু, আপনার বিরুদ্ধে কেস দাঁড় কারাবার মতো কিছু আমার হাতে নেই। যে-সব কথা আপনাকে বলেছি, সে-সব আমি কোর্টে টেকাতে পারব না, আমি সেই চেষ্টাও করব না। কাজেই আপনার ভয়ের কিছু নেই। তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আপনি থানায় গিয়ে অপরাধ স্বীকার করবেন। আচ্ছা, মেয়েটার নাম কি ছিল?
সুধাকান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, বিন্তি। ওর নাম বিন্তি।
ও আচ্ছা, বিন্তি।
মিসির আলি খুব আগ্রহ করে খাচ্ছেন। আমি দূরে থেকে তাঁকে দেখছি। সুধাকান্তবাবুও দেখছেন। তাঁর চোখে পদক পড়ছে না। সেই পদকহীন চোখে গভীর বিস্ময়।
মিসির আলি বললেন, খিচুড়ি তো ভাই অপূর্ব হয়েছে! আমাকে রেসিপিটা দেবেন তো! আমিও আপনার মতো একা-একা থাকি। মাঝে-মাঝে খিচুড়ি রান্না করব। বলেই মিসির আলি বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসলেন। আমি এর আগে এত অদ্ভুতভাবে কাউকে হাসতে শুনি নি, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
পরিশিষ্ট
আমার অধিকাংশ গল্পের শেষ থাকে না বলে পাঠক-পাঠিকারা আপত্তি তোলেন। এই গল্পের আছে। সুধাকান্তবাবু তাঁর অপরাধ স্বীকার করে থানায় ধরা দিয়েছিলেন। বিচার শুরু হবার আগেই থানা-হাজতে তাঁর মৃত্যু হয়।