সেটা সম্ভব হল না। আট মাসের শেষে হঠাৎ করে মেয়েটির ব্যথা উঠল। তাড়াহুড়ো করে তাকে নিয়ে যাওয়া হল ঢাকার নামকরা একটা ক্লিনিক। নম্যাল ডেলিভারি হল। রাত দুটোয় মেয়েটি একটি পুত্রসস্তান প্রসব করল।
মিসির আলি থামলেন। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, অনেকের সঙ্গে আমিও ক্লিনিকে অপেক্ষা করছিলাম। মেয়েটি আমার একজন রুগী, কাজেই আমার খানিকটা দায়িত্ব আছে। ক্লিনিকের পরিচালক একজন মহিলা ডাক্তার। তিনি আমাকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, যে-বাচ্চাটির জন্ম হয়েছে তাকে একটু দেখুন।
আমি দেখলাম।
একটা গামলার ভেতর বাচ্চাটিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। জেলি ফিস আপনি দেখেছেন কি না জানি না, শিশুটির সমস্ত শরীর জেলি ফিসের মতো স্বচ্ছ, থলথলে, গাঢ় নীল রঙ। শুধুমাথাটা মানুষের মাথাভর্তি রেশমি চুল। বড়-বড় চোখ। হাত-পা কিছু নেই। অক্টোপাসের মতো নলজাতীয় কিছু জিনিস কিলবিল করছে। …
আমি খুবই সাহসী মানুষ, কিন্তু এই দৃশ্য দেখে ভয়ে গা কাঁপতে লাগল।
ডাক্তার সাহেব বললেন, এই শিশুটিকৈ আপনি কী করতে বলেন?
আমি বললাম, আমার বলায় কিছু আসে-যায় না। বাচ্চার বাবা-মা কী বলেন?
বাচ্চার মাকে জানান হয় নি। তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। বাচ্চার বাবা চান না বাচ্চা বেঁচে থাকুক।…
আমি চুপ করে রইলাম। তিনি বললেন, এ-রকম অ্যাবনর্ম্যাল বাচ্চা এমিতেই মারা যাবে। আমাদের মারতে হবে না। প্রকৃতি এত বড় ধরনের অ্যাবনর্ম্যালিটি সহ্য করবে না।
আমি কিছু বললাম না। বাচ্চাটিকে ফুল স্পীড ফ্যানের নিচে রেখে দেওয়া হল। প্রচণ্ড শীতের রাত, বাচ্চাটির মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, এতেই তার মরে যাওয়া উচিত, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার-ভোর পাঁচটায় দেখা গেল, বাচ্চা দিব্যি সুস্থ। বড়-বড় চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, শিস দেওয়ার মতো শব্দ করছে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় সবার সম্মতি নিয়ে বাচ্চাটিকে এক শ সিসি ইমাডোজল ইনজেকশন দেওয়া হল। যেকোনো পূৰ্ণবয়স্ক লোক এতে মারা যাবে, কিন্তু তার কিছু হল না। শুধু শিস দেওয়ার ব্যাপারটা একটু কমে গেল। ভোর ছটায় দেওয়া হল পঞ্চাশ সিসি এটোজিন সলুশন। বাচ্চাটা মারা গেল ছাঁটা বিশে। বাচ্চার মা জানতে পারল না। সে তখনো ঘুমে অচেতন।
মিসির আলি গল্প শেষ করলেন। আমি বললাম, তারপর?
তারপর আবার কি? গল্প শেষ।
বাচ্চাটির মার কী হল?
বাচ্চার মার কী হল তা দিয়ে তো আমাদের প্রয়োজন নেই। রহস্য তো এখানে নয়। রহস্য হচ্ছে বাচ্চার মা যে-স্বপ্নগুলি দেখত সেখানে। সেই রহস্য আমি ভেদ করতে পারি নি। সুধাকান্তবাবুর রহস্যও শেষ পর্যন্ত ভেদ করতে পারব কি না তা জানি না।
আমার তো মনে হয় রহস্য ভেদ করেছেন।
কাগজপত্রে করেছি। কাগজপত্রে রহস্য ভেদ করা এক জিনিস, বাস্তব অন্য জিনিস। যখন সুধাকান্তবাবুর মুখোমুখি বসব তখন হয়তো দেখব গুছিয়ে-আনা জিনিস সব এলেমেলো হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার কী, জানেন ভাই? প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে না, সে নিজে কিন্তু খুব রহস্যময়।
কবে যাবেন সুধাকান্তবাবুর কাছে?
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই যাব। আপনি কি যাবেন আমার সঙ্গে?
আমি বললাম, অবশ্যই।
০৯. সুধাকান্তবাবুর বাড়ির উঠোনে
রাত প্রায় ন’টা।
আমি এবং মিসির আলি সুধাকান্তবাবুর বাড়ির উঠোনে বসে আছি। সুধাকান্তবাবু চুলায় চায়ের পানি চড়িয়েছেন। তিনি আমাদের যথেষ্ট যত্ন করছেন। মিসির আলিকে খুব আগ্রহ নিয়ে বাড়ি ঘুরে-ঘুরে দেখালেন। নানা গল্প করলেন।
বাড়ি আগের মতোই আছে। তবে কামিনী গাছ দুটির একটি নেই। মরে গেছে। কুয়ার কাছে সারি বেঁধে কিছু পেয়ারা গাছ লাগান হয়েছে, যা আগে দেখি নি।
সুধাকান্তবাবু বললেন, চা খেয়ে আপনারা বিশ্রাম করুন, আমি খিচুড়ি চড়িয়ে দিচ্ছি।
মিসির আলি অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললেন, খিচুড়ি মন্দ হবে না। তা ছাড়া শুনেছি আপনার রান্নার হাত অপূর্ব।
আমাদের চা দিয়ে সুধাকান্তবাবু খিচুড়ি চড়িয়ে দিলেন। মিসির আলি বললেন, রান্না করতে-করতে আপনি আপনার ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা বলুন। এটা শোনার জন্যেই এসেছি। আগেও এক বার এসেছিলাম, আপনাকে পাইনি।
জানি। খবর দিয়ে এলে থাকতাম। আমি বেশির ভাগ সময়ই থাকি।
শুরু করুন!
সুধাকান্তবাবু গল্প শুরু করলেন। ভৌতিক গল্পের জন্যে চমৎকার একটা পরিবেশ। অন্ধকার উঠেন। আকাশে নক্ষত্রের আলো। উঠোনের ওপর দিয়ে একটু পরপর হাওয়া বয়ে যাচ্ছে! একটা তক্ষক ডাকছে! তক্ষকের ডাক বন্ধ হবার সঙ্গে-সঙ্গে অসংখ্য ঝিঝিপোকা ডেকে উঠছে। বিঝিপোকা থামতেই তক্ষক ডেকে ওঠে। তক্ষকরা চুপ করতেই ডাকে ঝিঁঝিপোকা। অদ্ভুত কনসার্ট!
সুধাকান্ত গল্প বলে চলেছেন। মিসির আলি মাঝে-মাঝে তাঁকে থামাচ্ছেন। গভীর আগ্রহে বলছেন, এই জায়গাটা দয়া করে আরেক বার বলুন। অসাধারণ অংশ। গা শিউরে উঠছে।
সুধাকান্তবাবু তাতে বিরক্ত হচ্ছেন না। সম্ভবত মিসির আলির গভীর আগ্রহ তাঁর ভালো লাগছে।
যেখানে মেয়েটি সুধাকান্তবাবধু পা কামড়ে ধরে, সেই অংশ মিসির আলি তিন বার শুনলেন। শেষ বার গভীর আগ্রহে বললেন, আপনি যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন মেয়েটি পিছন থেকে আচমকা আপনাকে কামড়ে ধরল?
জ্বি।
হাত দিয়ে ধরল না, আচড় দিল না—শুধু কামড়ে ধরল?
দেখি কামড়ের দাগটা।
তিনি কামড়ের দাগ দেখালেন। মিসির আলি পায়ের দাগ পরীক্ষা করলেন। জড়ান গলায় বললেন, কী অদ্ভুত গল্প তারপর কী হল?