আমি মিসির আলির প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। এগার নম্বর বেডের দিকে তাকলাম। ষোল-সতের বছরের এক জন যুবক অসুস্থ ভাইয়ের পাশে বসে আছে। আমি বললাম, ছেলেটি কি এখনো না-খেয়ে আছে?
হ্যাঁ। আমি নার্সের হাতে তার জন্যে পঞ্চাশটা টাকা পাঠিয়েছিলাম। সে রাখে নি। বড়ই কষ্ট হচ্ছে হুমায়ূন সাহেব!
আমি মিসির আলির হাত ধরলাম। এই প্রথম বুঝলাম-এই মানুষটি আমাদের আর দশটি মানুষের মতো ময়। এই রোগা আধপাগলা মানুষটির হৃদয়ে সমুদ্রের ভালবাসা সঞ্চিত আছে। এদের স্পর্শ করলেও পুণ্য হয়!
হুমায়ূন সাহেব।
জ্বি।
এই খাতাটা আপনি মনে করে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।
কী খাতা?
সুধাকান্তবাবুর বিষয়ে এই খাতায় অনেক কিছু লিখে রেখেছি। বাসায় নিয়ে মন দিয়ে পড়বেন।
শরীরের এই অবস্থায়ও আপনি সুধাকান্তবাবুকে ভুলতে পারেন নি?
হাসপাতালে শুয়ে-শুয়ে এইটা নিয়েই শুধু ভাবতাম। কিছু করার ছিল না তো! অনেক নতুন-নতুন পয়েন্ট ভেবে বের করেছি। সব লিখে ফেলেছি।
ভালো করেছেন। এখন বিশ্রাম করুন। আমি খাতা নিয়ে যাচ্ছি। কাল আবার আসব।
মিসির আলি নিচু গলায় বললেন, এক বার কি চেষ্টা করে দেখবেন ঐ ছেলেটিকে বাইরে নিয়ে কিছু খাওয়ান যায় কি না?
আমি দেখব। আপনি এই নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।
আমি ব্যস্ত হচ্ছি না।
চলে আসার আগে-আগে মিসির আলি বললেন, আপনি কষ্ট করে আমাকে দেখতে এসেছেন, আমি খুবই আনন্দিত।
আমি আবার লজ্জা পেলাম।
০৭. মিসির আলির খাতা নিয়ে বসা হল না
ব্যক্তিগত কাজ অনেক জমে ছিল, মিসির আলির খাতা নিয়ে বসা হল না। আমি তেমন উৎসাহও বোধ করছিলাম না। সামান্য গল্প নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ির আমি কোনো অর্থ দেখি না। আমি লক্ষ করেছি–গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি বেশির ভাগ মানুষ সম্পূর্ণ অবহেলা করে, মাতামতি করে তুচ্ছবিষয় নিয়ে। মিসির আলিও নিশ্চয় এই গোত্রের। পরিবারপরিজনহীন মানুষদের জন্যে এর অবশ্যি প্রয়োজন আছে। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাক।–জীবন পার করে দেওয়া।
এক রাতে শোবার আগে খাতা নিয়ে বসলাম। পাতা উল্টে আমার আক্কেলগুড়ুম। এক শ ছিয়াশি পৃষ্ঠার ঠাসবুনোন লেখা। সুধাকান্তবাবু এবং তার গল্প নিয়ে যে এত কিছু লেখা যায় কে জানত। পরিষ্কার গোটা-গোটা লেখা। পড়তে খুব আরাম।
অবাক হয়ে লক্ষ করলাম। আমাকে নিয়ে তিনি আট পৃষ্ঠা লিখেছেন। সেই অংশটিই প্রথম পড়লাম। শুরুটা এ-রকম–
নাম : হুমায়ূন আহমেদ। বিবাহিত, তিনি কন্যার জনক। পেশা অধ্যাপনা।
বদমেজাজি। অহঙ্কারী। অধ্যাপকদের যেটা বড় ত্রুটি—অন্যদের বুদ্ধিমত্তা খাটো করে দেখা, ভদ্রলোকের তা আছে।
এই ভদ্রলোকের স্মৃতিশক্তি ভালো। তিনি গল্পটি দুবার আমাকে বলেছেন। দু বারই এমনভাবে বলেছেন যে, একটি শব্দ এদিক-ওদিক হয় নি। তাঁর কথাবার্তায় চিরকুমার সুধাকান্তবাবুর প্রতি গভীর মমতা টের পাওয়া যায়। এই মমতার উৎস কী?
সুধাকান্তবাবু এই ভদ্রলোককে ক্ষুধার্ত অবস্থায় চমৎকার কিছু খাবার রান্না করে খাইয়েছেন—এইটাই কি একমাত্র কারণ? আমার মনে হয়। সুধাকান্তবাবুর চেহারা, কথাবার্তাও ভদ্রলোকের ওপর খানিকটা প্রভাব ফেলেছে। সুধাকান্তবাবু অতি অল্প সময়ে এই বুদ্ধিমান মানুষটিকে প্রভাবিত করেছেন। কাজেই ধরে নেওয়া যায়, মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা সুধাকান্তবাবুর আছে। আমরা তাহলে কি ধারণা করতে পারি না, সুধাকান্তবাবু তাঁর আশেপাশের মানুষদেরও প্রভাবিত করেছেন?
সুধাকান্তবাবুকে নিয়ে তিনটি অধ্যায় আছে। প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম–পূর্বপরিচয়। এই অংশে সুধাকান্তবাবুর পরিবারের যাবতীয় বিবরণ আছে।
বাবার নাম, দাদার নাম, মার নাম। তাঁরা কে কেমন ছিলেন, কী করতেন। কে কীভাবে মারা গেলেন। দেশত্যাগ করলেন কবে। কেন করলেন। এত তথ্য ভদ্রলোক কীভাবে জোগাড় করলেন, কেনই-বা করলেন কে জানে!
দ্বিতীয় অধ্যায়টির নাম-সুধাকান্তবাবুও তাঁর বাগদত্তা। এই অধ্যায়টি বেশ ছোট। পড়ে মনে হল মিসির আলি তেমন কোনো তথ্য জোগাড় করতে পারেন নি।
তৃতীয় অধ্যায় সু র চরিত্র এবং মনমানসিকতা নিয়ে। শুরুটা এমন—
ভদ্রলোক নিজেকে সাধুশ্রেণীতে ফেলেছেন। শুরুতেই তিনি বলছেন যে, সাধুসন্ন্যাসীর জীবনযাত্রায় তাঁর আগ্রহ আছে। শ্মশানে-শ্মশানে ঘুরতেন, এবং স্থানীয় লোকজনও তাঁকে সাধুবাবা বলে। নিজের সাধু-চরিত্রটির প্রতি ভদ্রলোকের দুর্বলতা আছে। অন্যকে বলে না— আমি সাধু। ইনি তা বলছেন, কাজেই ধরে নেওয়া যাক ইনি আমাদের মতোই দোষগুণসম্পন্ন সাধারণ একজন মানুষ।
তিনি নিঃসঙ্গ জীবন ঠিক পছন্দ করেন বলেও মনে হল না। অনেক রাতে বাড়ি ফেরেন, যাতে এক-একা খুব অল্প সময় তাঁকে থাকতে হয়। এক জন সাধকশ্রেণীর মানুষের চরিত্রের সঙ্গেও ব্যাপারটা মিশ খায় না।–
মিসির আলির খাতা শেষ করতে-করতে রাত দুটো বেজে গেল। পরিশিষ্ট অংশে ভদ্রলোক ছটি প্রশ্ন তুলেছেন। এবং বলছেন-রহস্য উদ্ধারের জন্যে এই প্রশ্নগুলির জবাব জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই ছটি প্রশ্ন পড়ে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। এ কী কাণ্ড। মিসির আলি সাহেবের খাতা আবার গোড়া থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়লাম। ছটা প্রশ্নের কাছে এসে আবার চমকালাম। আমার মাথা ঘুরতে লাগল। ইচ্ছে করল এক্ষুণি ছুটে যাই মিসির আলির কাছে।
০৮. মিসির আলি সাহেব আজ অনেক সুস্থ
মিসির আলি সাহেব আজ অনেক সুস্থ। গায়ে চাদর জড়িয়ে বিছানায় বসে আছেন। হাতে শিবরাম চক্রবর্তীর বই জন্মদিনের উপহার। কিছুক্ষণ পড়ছেন, তারপর গা দুলিয়ে হাসছেন। আবার পড়ছেন, আবার হাসছেন।