আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। লোকটার ওপর খানিকটা রাগ হচ্ছে। এককথায় সে বলে দিল গল্প বানান?
মিসির আলি বললেন, আপনার সঙ্গে যখন গল্প করছিলেন, তখন ভয় পেয়ে ভদ্রলোক মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন, অথচ ঐ রাতে করলেন না। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?
আমি বললাম, সুধাকান্তবাবু শুধু-শুধু এ-রকম একটা গল্প বানাবেন কেন? এই রকম একটা গল্প তৈরির পিছনে কোনো একটা কারণ থাকবে নিশ্চয়ই!
তা তো থাকবেই। তাঁরও আছে।
কী কারণ?
অনেক কারণ হতে পারে। তবে আমার যা মনে হয, তা হচ্ছে উনি নিঃসঙ্গ ধরনের মানুষ, এই জাতীয় একটা গল্প তৈরি করে নিজে সবার আকর্ষণের কেন্দ্ৰবিন্দুতে চলে এসেছেন। এটা এক জন নিঃসঙ্গ মানুষের জন্যে কম কথা নয়।
মিসির আলি লোকটির প্রতি আমার ভক্তি হল। লজিক বা যুক্তি নামক ব্যাপারটা যে কত শক্তিশালী হতে পারে, মিসির আলি তা আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
আমি বললাম, এই গল্পটা যে সত্যি, এটা আপনি কখন স্বীকার করবেন? অৰ্থাৎ কোন প্রমাণ উপস্থিত করলে আপনি গল্পটা মেনে নেবেন?
মিসির আলি হাসাতে-হাসতে বললেন, ঐ মেয়েটির ডেডবিড়ি যদি অন্যরা দেখে থাকে এবং কবর দেওয়া হয় বা দাহ করা হয়, তবেই আমি ঘটনাটা মেনে নেব।
আমি আপনাকে খবরটা এনে দেব। আমি চিঠি লিখে খবরটা জোগাড় করব। আপনি আপনার ঠিকানা লিখে রেখে যান।
মিসির আলি তাঁর ঠিকানা লিখে রেখে চলে গেলেন। আশ্চৰ্য্য কাণ্ড, আজও তাঁর পলিথিনের ব্যাগ ফেলে গেলেন। ব্যাগের ভেতর ছোট্ট একটা পাউরুটি, একটা কলা এবং এক টুকরো মাখন। গরমে সেই মাখন গলে ব্যাগময় ছড়িয়ে পড়েছে।
০৬. চিঠি লিখলাম
চিঠি লিখলাম আমার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে যে-মেয়েটির বিয়ের কথা হয়েছিল, সেই মেয়ের বড়চাচাকে। আমার ধারণা ছিল ভদ্রলোক জবাব দেবেন না। যে-পরিচয়ের সূত্র ধরে চিঠি লিখেছি, সেই সূত্রে চিঠির জবাব দেওয়ার কথা নয়। ভদ্রলোক কিন্তু জবাব দিলেন। এবং বেশ গুছিয়েই জবাব দিলেন।
আপনার পত্র পাইয়াছি।
এক নিতান্ত দুর্ভাগ্যজনক অবস্থায় আপনাদের সহিত পরিচয় হইয়াছিল। আপনি যে সেই পরিচয় মনে রাখিয়া পত্ৰ দিয়াছেন তাহাতে কৃতজ্ঞ হইলাম। আপনি আমার ভাইস্তি প্রসঙ্গে জানিতে চাহিয়াছেন। দুই বৎসর আগে তাহার বিবাহ হইয়াছে। এই খবর তো আপনার জানা। সে এখন তাহার স্বামীর সহিত ইরাকে আছে। তাহার স্বামী একজন ডাক্তার। আপনাদের দোয়ায় তাহারা ভালোই আছে। দ্বিতীয় যে—বিষয়টি আপনি জানিতে চাহিয়াছেন, তাহার সবই সত্য। কুকুরের কামড়ে ছিন্নভিন্ন বালিকাটির দেহ আমরা সবাই দেখিয়াছি। তাহার মৃতদেহ সৎকারের কোনো ব্যবস্থা হয় নাই, কারণ বালিকাটি হিন্দু কি মুসলিম তাহা জানা সম্ভব হয় নাই।
ঘটনাটি সেই সময় জনমনে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার মফস্বল পাতায় খবরও ছাপা হইয়াছিল। অধিক আর কি? আমরা ভালো আছি। আপনার সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করি।
আমি চিঠিটি ডাকযোগে মিসির আলির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। মনে-মনে হাসলাম। অভ্রান্ত যুক্তিও মাঝে-মাঝে অচল হয়ে যায়। এই চিঠিটি হচ্ছে তার প্রমাণ।
চিঠি পাঠাবার তৃতীয় দিনের মাথায় মিসির আলি এসে উপস্থিত। আমি হেসে বললাম, কি, গল্পটা এখন বিশ্বাস করলেন?
মিসির আলি শুকনো গলায় বললেন, হুঁ।
তাঁকে খুব চিন্তিত মনে হল।
আমি বললাম, আপনাকে এত চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন?
মিসির আলি বললেন, আমি আপনার কাছ থেকে গল্পটা আবার শুনতে চাই।
কেন?
প্লীজ, আরেক বার বলুন।
আবার কেন?
বলুন শুনি।
আমি দ্বিতীয় বার গল্পটা শুরু করলাম। এক জায়গায় মিসির আলি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কত তারিখ বললেন?
বারই কার্তিক। এই তারিখে ঘটনাটা ঘটল।
বারই কাৰ্ত্তিক তারিখটা আপনার মনে আছে?
হ্যাঁ, আছে। প্রথম বার যখন আপনাকে গল্পটা বলি, তখনও তো বারই কাৰ্তিক বলেছিলাম বলে আমার মনে হয়।
হ্যাঁ, বলেছিলেন। আজও সেই একই তারিখ বলেন কি না। তাই দেখতে চেয়েছি। এই তারিখটা বেশ জরুরি।
জরুরি কেন?
বলছি কেন। তার আগে আপনি বলুন বার তারিখটা আপনার মনে রইল কেন? এসব দিন-তারিখ তো আমাদের মনে থাকে না।
বার তারিখ আমার বড়মেয়ের জন্মদিন। কাজেই সুধাকান্তবাবু বার তারিখ বলমাত্র আমার মনে গেঁথে গেল। তা ছাড়া আমার স্মৃতিশক্তি ভালো।
তাই তো দেখছি!
এখন বলুন তারিখটা এত জরুরি কেন?
যে-বছরে ঘটনাটা ঘটল, আমি সেই বছরের পঞ্জিকা দেখেছি। বার তারিখ হচ্ছে ২৪শে অক্টোবর। স্কুল ছুটি থাকে। ঐদিন লক্ষ্মীপূজার বন্ধ। কাজেই আপনার সুধাকান্তবাবু আপনাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ঐদিন স্কুল করেছেন।
হয়তো উনিই তারিখটা ভুল বলেছেন।
হ্যাঁ, তা হতে পারে। তবে আমি তাঁর নিজের মুখে ঘটনাটা শুনতে চাই।
আবার শুনতে চান?
হ্যাঁ।
কেন? ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছি না।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, বিশ্বাস করতে না চাইলে করবেন না। আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে এমন কোনো কথা আছে?
মিসির আলি বললেন, আপনি কি একটু যাবেন আমার সঙ্গে?
কোথায়?
ঐ জায়গায়?
কেন?
তাহলে জেনে আসতাম। তারিখটা বার কিনা।
আপনি কি পাগল নাকি ভাই?
মিসির আলি বললেন, ব্যাপারটা খুব জরুরি। আমাকে জানতেই হবে।
জানতে হলে আপনি যান। আমি আপনাকে ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।
আপনি যাবেন না?
জ্বি-না। আজেবাজে ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামোনর সময় আমার নেই।