ধাকান্তবাবু বলতে শুরু করলেন—
গত বৎসরের কথা। কার্তিক মাস। আমি বাড়িতে ফিরছি। রাত প্রায় দশটা কিংবা তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। আমার ঘড়ি নেই, সময়ের হিসাব ঠিক থাকে না।
আমি সুধাকান্তবাবুকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার স্কুল তো নিশ্চয়ই চারটা-পাঁচটার দিকে ছুটি হয়। এত রাতে ফিরছিলেন কেন?
সুধাকান্তবাবু নিচু গলায় বললেন, রোজই এই সময়ে বাড়ি ফিরি। সকাল-সকল বাড়ি ফেরার কোনো উৎসাহ বোধ করি না। পাবলিক লাইব্রেরি আছে, ঐখানে পত্রিকাটত্রিকা পড়ি, গল্পের বই পড়ি।
বলুন তারপর কী হল।
তারিখটা হচ্ছে বারই কীৰ্তিক, সোমবার। আমি মানুষ হিসাবে বেশ সাহসী। রাতবিরাতে এক-একা ঘোরাফেরা করি। ঐ রাতে রাস্তায় নেমেই আমার ভয়ভয় করতে লাগল। কী জন্যে ভয় করছে সেটাও বুঝলাম না। তখন মনে হল–রাস্তায় একটা পাগলা কুকুর বের হয়েছে, ভয়টা বোধহয় ঐ কুকুরের কারণে। আমি একটা লাঠি হাতে নিলাম। …
শুক্লপক্ষের রাত। ফক্ফকা জ্যোৎস্না, তবু পরিষ্কার সবকিছু দেখা যাচ্ছে না। কারণ কুয়াশা। কাৰ্তিক মাসের শেষে এদিকে বেশ কুয়াশা হয়। …
নদীর কাছাকাছি আসতেই কুকুরটাকে দেখলাম। গাছের নিচে শুয়ে ছিল। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল এবং পিছনে-পিছনে আসতে লাগল। মাঝে-মাঝে চাপা। শব্দ করছে। পাগলা কুকুর পিছনে-পিছনে আসছে, আমি এগুচ্ছি।–ব্যাপারটা খুব ভয়াবহ। যে-কোনো মুহূর্তে এই কুকুর ছুটে এসে কামড়ে ধরতে পারে। কুকুরটাকে তাড়াবার চেষ্টা করলাম। টিল ছুড়লাম, লাঠি দিয়ে ভয় দেখলাম। কুকুর নড়ে না, দাঁড়িয়ে থাকে। চাপা শব্দ করতে থাকে। আমি হাঁটতে শুরু কললেই সেও হাঁটতে শুরু করে। …
যাই হোক, আমি কোনোক্রমে নদীর পাড়ে এসে পৌঁছলাম। তখন আমার খানিকটা সাহস ফিরে এল। কারণ, পাগলা কুকুর পানিতে নামে না। পানি দেখলেই এরা ছুটে পালায়। …
।অদ্ভুত কাণ্ড, কুকুর পানি দেখে ছুটে পালাল না! আমার পিছন-পিছন নেমে পড়ল। আমার বিশ্বয়ের সীমা রইল না। …
আমি নদীর ও-পারে উঠলাম। কুকুরটাও উঠল—আর ঠিক তখন একটা ব্যাপার ঘটল।
সুধাকান্তবাবু থামলেন।
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, আপনি জটিল জায়গাগুলিতে দয়া করে থামবেন না। গল্পের মজা নষ্ট হয়ে যায়।
সুধাকান্তবাবু বললেন, এটা কোনো গল্প না। ঘটনাটা কীভাবে বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না বলে থেমেছি।
আপনি মোটামুটিভাবে বলুন, আমি বুঝে নেব।
কুকুরটা আমার খুব কাছাকাছি চলে এল। পাগলা কুকুর আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। কিনা জানি না। ভয়ংকর দৃশ্য! সারাক্ষণ হাঁ করে থাকে। মুখ দিয়ে লালা পড়ে, চোখের দৃষ্টিটাও অন্য রকম। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেছি। ছুটে পালাব বলে ঠিক করেছি, ঠিক তখন কুকুরটা কেন জানি ভয় পেয়ে গেল। অস্বাভাবিক ভয়। একবার এ—দিকে যাচ্ছে, একবার ও-দিকে যাচ্ছে। চাপা আওয়াজটা তার গলায় আর নেই। সে ঘেউঘেউ করছে। আমার কাছে মনে হল, সে কুকুরের ভাষায় আমাকে কী যেন বলার চেষ্টা করছে। এ-রকম চলল মিনিট পাঁচেক, তার পরই সে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাঁতরে ও—পারে চলে গেল। পুরোপুরি কিন্তু গেল না, ও-পারে দাঁড়িয়ে রইল এবং ক্ৰমাগত ডাকতে লাগল।
তারপর?
আমি একটা সিগারেট ধরলাম! তখন আমি ধূমপান করতাম। মাস তিনেক হল ছেড়ে দিয়েছি। যাই হোক, সিগারেট ধরাবার পর ভয়টা পুরোপুরি কেটে গেল। হাত থেকে লাঠি ফেলে দিলাম। বাড়ির দিকে রওনা হব বলে ভাবছি, হঠাৎ মনে হল নদীর ধার ঘেষে বড়ো-হওয়া ঘাসগুলোর মাঝখান থেকে কী- একটা যেন নড়ে উঠল।
আপনি আবার ভয় পেলেন?
না, ভয় পেলাম না। একবার ভয় কেটে গেলে মানুষ চট করে আর ভয় পায় না। আমি এগিয়ে গেলাম!
কুকুরটা তখনো আছে?
হ্যাঁ, আছে।
তারপর বলুন।
কাছাকাছি। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটা মেয়ের ডেডবিডি। এগার-বার বছর বয়স। পরনে ডোরাকাটা শাড়ি।
বলেন কী আপনি!
যা দেখলাম তাই বলছি।
মেয়েটা যে মরে আছে তা বুঝলেন কী করে?
যে-কেউ বুঝবে। মেয়েটা মরে শক্ত হয়ে আছে। হাত মুঠিবদ্ধ করা। মুখের কষে রক্ত জমে আছে।
কী সৰ্ব্বনাশ!
ভয় পেলেন না?
না, ভয় পেলাম না! আপনাকে তো আগেই বলেছি, একবার ভয় পেলে মানুষ দ্বিতীয় বার চট করে ভয় পায় না।
তারপর কী হল বলুন।
মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চা একটা মেয়ে এইভাবে মরে পড়ে আছে, কেউ জানছে না। কীভাবে না জানি বেচারি মরল। ড়েড়বডি এখানে ফেলে রেখে যেতে ইচ্ছা করল না। ফেলে রেখে গেলে শিয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে। আমার মনে হল এই মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়া উচিত।
আশ্চর্য তো।
আশ্চর্যের কিছু নেই। আমার অবস্থায় পড়লে আপনিও ঠিক তাই করতেন।
না, আমি তা করতাম না। চিৎকার করে লোক ডাকাডাকি করতাম।
আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। কাকে আপনি ডাকতেন?
তারপর কী হল বলুন।
সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি আমাকে একটা সিগারেট দিন। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে।
আমি সিগারেট দিলাম। বৃদ্ধ সিগারেট ধরিয়ে খিকখিক করে কাশতে লাগলেন।
আমি বললাম, তারপর কী হল বলুন।
সুধাকান্তবাবু বললেন, ঘটনাটা এখানে শেষ করে দিলে কেমন হয়? আমার কেন জানি আর বলতে ইচ্ছা করছে না।
ইচ্ছে না করলেও বলুন। এখানে গল্প শেষ করার প্রশ্নই ওঠে না।
এটা গল্প না।
গল্প না যে তা বুঝতে পারছি। তারপর বলুন আপনি কী করলেন। মেয়েটাকে তুললেন?
হাঁ তুললাম। কেন তুললাম সেটাও আপনাকে বলি। একটা অপরিচিত মেয়ের শবদেহ কেউ চট করে কোলে তুলে নিতে পারে না। আমি এই কাজটা করলাম, কারণ এই বালিকার মুখ দেখতে অবিকল …