সুধাকান্তবাবু বললেন, ওটা কিছু না।
আমি ভয়-জড়ানো গলায় বললাম, কিছু না মানে?
ওটা খাটাশ। মানুষের মতো শব্দ করে হাসে।
বলেন কী! খাটাশের নাম তো এই প্রথম শুনলাম! এ তো ভূতের বাবা বলে মনে হচ্ছে! এখনো আমার গা কাঁপছে।
জল খান। জল খেলে ভয়টা কমবে।
সুধাকান্তবাবু কাঁসার গ্লাসে করে পানি নিয়ে এলেন। খাটাশ নামক জন্তুটি আরেক বার রক্ত হিম-করা হাসি হাসল। সুধাকান্তবাবু যদি কিছু না বলতেন তাহলে ভূতের হাসি শুনেছি, এই ধারণা সারা জীবন আমার মনের মধ্যে থাকত।
লোকটার প্রতি এই প্ৰথম আমার খানিকটা আস্থা হল। আজগুবি গল্প বলে ভয় দেখান এই লোকের ইচ্ছা নয় বলেই মনে হল। এ-রকম ইচ্ছা থাকলে, এই ভয়ংকর হাসির কারণ সম্পর্কে সে চুপ করে থাকত।
সুধাকান্তবাবু বললেন, ঐ মেয়েটার কথা শুনবেন?
হ্যাঁ, শোনা যেতে পারে। তবে আমি নিজে অবিশ্বাসী ধরনের মানুষ, কাজেই গল্পের মাঝখানে যদি হেসে ফেলি কিছু মনে করবেন না।
এই গল্পটা কাউকে বলতে ভালো লাগে না। অবশ্যি অনেককে বলেছিা! এখানকার সবাই জানে।
আপনার গল্প এখানকার সবাই বিশ্বাস করেছে?
সুধাকান্তবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, আমি যদি এখানকার কাউকে একটা মিথ্যা কথাও বলি, এরা বিশ্বাস করবে। এরা আমাকে সাধুবাবা বলে ডাকে। আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে কোনো মিথ্যা কথা বলেছি বলে মনে পড়ে না। আমি থাকি এক-একা। আমার প্রয়োজনও সামান্য। মানুষ মিথ্যা কথা বলে প্রয়োজন এবং স্বার্থের কারণে। আমার সেই সমস্যা নেই। এইসব থাক, আমি বরং গল্পটি বলি।
বলুন।
ভেতরে গিয়ে বসবেন? এখানে মনে হচ্ছে একটু ঠাণ্ডা লাগছে। অগ্রহায়ণ মাসে হিম পড়ে।
আমার অসুবিধা হচ্ছে না, এখানেই বরং ভালো লাগছে। গ্রামে তেমন আসা হয় না। আপনি শুরু করুন।
সুধাকান্তবাবু গল্প শুরু করতে গিয়েও শুরু করলেন না; হঠাৎ যেন একটু অন্য রকম হয়ে গেলেন। যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছু দেখতে চেষ্টা করছেন। খসখস শব্দ হল। নতুন কাপড় পরে হাঁটলে যেমন শব্দ হয়, সে-রকম। তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কাঁচের চুড়ির টুং-টুং শব্দের মতো শব্দ। আমি বললাম, কী ব্যাপার বলুন তো?
সুধাকান্তবাবু ফ্যাকাসে মুখে হাসলেন। আমি বললাম, কিসের শব্দ হল?
তিনি নিচু গলায় বললেন, ও কিছু না, আপনি গল্প শুনুন। আজ ঘুমিয়ে কাজ নেই, আসুন গল্প করে রাত পার করে দিই।
গা-ছিমছমে পরিবেশ। বাড়ির লাগোয়া ঝাঁকড়া কামিনী গাছ থেকে কামিনী ফুলের নেশা-ধরান গন্ধ আসছে। কুয়ার আশেপাশে অসংখ্য জোনাকি জ্বলছে–নিভছে। উঠোনের চুলা থেকে ভেসে আসছে পোড়া কাঠের গন্ধ। আকাশ-ভরা নক্ষত্ৰবীথি।
সুধাকান্তবাবু গল্প শুরু করলেন।
০২. সাধুবাবা
যুবক বয়স থেকেই আমাকে সবাই ডাকত সাধুবাবা। . . . .
যদিও ঠিক সাধু বলতে যা বোঝায় আমি তী নই। তবে প্রকৃতিটা একটু ভিন্ন ছিল। সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে-দূরে রাখার স্বভাব আমার ছিল। শ্মশান, কবরস্থান এইসব আমাকে ছোটবেলা থেকেই আকর্ষণ করত। অল্প বয়স থেকেই শ্মশান এবং কবরস্থানের আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম। আমার বাবা শ্যামাকান্ত স্ট্রেমিক তখন জীবিত। আমার মতিগতি দেখে অল্প বয়সেই আমার বিবাহ ঠিক করলেন। পাশের গ্রামের মেয়ে। ভবানী মিত্ৰ মহাশয়ের প্রথমা কন্যা আরতি। খুবই রূপবতী মেয়ে। গ্রামাঞ্চলে এ-রকম মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। আমি বিবাহ করতে রাজি হলাম! কথাবার্তা পাকাপার্কি হয়ে যাবার পর একটা দুর্ঘটনায় মেয়েটা মারা যায়।
কী দুর্ঘটনা?
সাপের কামড়। আমাদের এই অঞ্চলে সাপের উপদ্রব আছে। বিশেষ করে কেউটে সাপ
তারপর কী হল বলুন।
মেয়েটির মৃত্যুতে খুব শোক পেলাম। প্রায় মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। কিছুই ভালো লাগে না। রাতবিরাতে শ্মশানে গিয়ে বসে থাকি। সমাজ-সংসার কিছুতেই মন বসে না। গভীর বৈরাগ্য। কিছুদিন সাধু-সন্ন্যাসীর খোঁজ করলাম। ইচ্ছা ছিল উপযুক্ত গুরুর সন্ধান পেলে মন্ত্র নেব! তেমন কাউকে পেলাম না।
আমার বাবা অন্যত্র আমার বিবাহের চেষ্টা করলেন। আমি রাজি হলাম না। বাবাকে বুঝিয়ে বললাম যে, ঈশ্বরের ইচ্ছা না যে আমি সংসারের বন্ধনে আটকা পড়ি। পরিবারের অন্যরাও চেষ্টা করলেন–আমি সম্মত হলাম না। এ-সব আমার প্রথম যৌবনের কথা। না-বললে আপনি গল্পটা ঠিক বুঝতে পারবেন না। আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?
আমি বললাম, না, বিরক্ত হব কেন?
সুধাকান্তবাবু বললেন, প্রথম যৌবনের কথা সবাই খুব আগ্রহ করে বলে। আমি বলতে পারি না।
আপনি তো ভালোই বলছেন। থামবেন না—বলতে থাকুন।
সুধাকান্তবাবু আবার শুরু করলেন—
এরপর অনেক বছর কাটল। শ্মশানে-শ্মশানে ঘুরতাম বলেই বোধহয় ঈশ্বর আমার ঘরটাকেই শ্মশান করে দিলেন। পুরোপুরি একা হয়ে গেলাম। মানুষ যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়। আমিও মানিয়ে নিলাম। আমার প্রকৃতির মধ্যে একধরনের একাকীত্ব ছিল, কাজেই আমার খুব অসুবিধা হল না। এখন আমি মূল খলমুলুমসব তার আগে আপনি কি খাবেন?
জ্বি-না।
খান একটু চা, ভালো লাগবে।
আমার মনে হল ভদ্রলোকের নিজেরই চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে! আমি বললাম, ঠিক আছে, বানান। একটু ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগছে অবশ্যি।
ভিতরে গিয়ে বসবেন?
জ্বি-না, এখানেই ভালো লাগছে।
চা শেষ করার পর দ্বিতীয় দফায় গল্প শুরু হল। এইখানে আমি একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম। আমার কাছে মনে হল ভদ্রলোকের গলার স্বর পান্টে গেছে। আগে যে-স্বরে কথা বলছিলেন, এখন সেই স্বরে বলছেন না! একটা পরিবর্তন হয়েছে। আমার মনের ভুল হতে পারে। অনেক সময় পরিবেশের কারণে সবকিছু অন্য রকম মনে হয়।