রান্নাবান্না। আপনি নিজেই করেন?
হ্যাঁ, নিজেই করি। এক বেলা রান্না করি। এক বেলা ভাত খাই, আর সকালে চিড়া, ফলমূল-এ—সব খাই।
কাজের লোক রাখেন না কেন?
দরকার পড়ে না।
খালি বাড়ি পড়ে থাকে, চুরি হয় না?
না। চোর নেবে কী? আমি এক জন দরিদ্র মানুষ। আপনি স্নান করে নিন। স্নান করলে ভালো লাগবে।
অপরিচিত জায়গায় ঠাণ্ডার মধ্যে গায়ে পানি ঢালার আমার কোনোই ইচ্ছে ছিল কুৰুসুধাকান্তবাবু মনে হচ্ছে আমাকে না ভিজিয়ে ছাড়বেন না। লোকটি সম্ভবত শুচিবাইগ্রস্ত।
কুয়ার পানি নদীর পানির মতো গরম নয়, খুব ঠাণ্ডা। পানি গায়ে দিতেই গা জুড়িয়ে গেল। সারা দিনের ক্লান্তি, বিয়েবাড়ির উদ্বেগ, মৃত্যুসংক্রান্ত জটিলতা—সব ধুয়ে-মুছে গেল। চমৎকার লাগতে লাগল। তা ছাড়া পরিবেশটাও বেশ অদ্ভুত। পুরনো ধরনের একটা বাড়ি। ঝকঝকে উঠোনের শেষ প্রান্তে শ্যাওলা-ধরা কুয়া। আকাশে পরিষ্কার চাঁদ। কামিনী ফুলের গাছ থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি গন্ধ। এক ঋষির মতো চেহারার চিরকুমার বৃদ্ধ রান্না বসিয়েছেন। যেন বিভূতিভূষণের উপন্যাসের কোনো দৃশ্য।
সুধাকান্তবাবু?
বলুন!
রান্নার কত দুর?
দেরি হবে না।
এক-একা থাকতে আপনার খারাপ লাগে না?
না, অভ্যোস হয়ে গেছে।
বাসায় ফিরে আপনি করেন কী?
তেমন কিছু করি না। চুপচাপ বসে থাকি।
ভয় লাগে না?
সুধাকান্তবাবু এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না।
খাবার আয়োজন সামান্য, তবে এত চমৎকার রান্না আমি দীর্ঘদিন খাই নি। একটা কিসের যেন ভাজি, তাতে পাঁচফোড়নের গন্ধ-খেতে একটু টক-টক। বেগুন দিয়ে ডিমের তরকারি, তাতে ডালের বড়ি দেওয়া! ডালের বড়ি এর আগে আমি খাই নি! এমন একটা সুখাদ্য দেশে প্রচলিত আছে তা-ই আমার জানা ছিল না। মুগের ডাল! ডালে ঘি দেওয়াতে অপূর্ব গন্ধ।
আমি বললাম, সুধাকান্তবাবু, এত চমৎকার খাবার আমি আমার জীবনে খাই নি। দীর্ঘদিন মনে থাকবে।
সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি ক্ষুধার্ত ছিলেন, তাই এত ভালো লেগেছে। রুচির রহস্য ক্ষুধায়। যেখানে ক্ষুধা নেই, সেখানে রুচিও নেই।
আমি চুমৎকৃত হলাম।
লোকটির চেহারাই শুধু দার্শনিকের মতো না, কথাবার্তাও দর্শনঘেঁষা।
সুধাকান্তবাবু উঠোনে পাটি পেতে দিলেন। খাওয়াদাওয়ার পর সিগারেট হাতে সেখানে বসলাম। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করা যেতে পারে। সুধাকান্তবাবুকে অবশ্যি খুব আলাপী লোক বলে মনে হচ্ছে না। এই যে দীর্ঘ সময় তাঁর সঙ্গে আছি, তিনি এর মধ্যে আমার নাম জানতে চান নি। আমি কী করি তাও জানতে চান নি। আমি এই মানুষটির প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ বোধ করছি, কিন্তু এই লোকটা আমার প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করছে না। অথচ আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যারা মাষ্টারি করে, তারা কথা বলতে খুব পছন্দ করে। অকারণেই কথা বলে।
প্রায় মিনিট পনের আমরা চুপচাপ বসে থাকার পর সুধাকান্তবাবু আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, আপনি করছিলেন এক-একা আমি এই বাড়িতে থাকতে ভয় পাই কি না, তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ, তাই।
সুধাকান্তবাবু বললেন, ভয় পাই। প্রায় রাতেই ঘুমুতে পারি না, জেগে থাকি। ঘরের ভেতর আগুন করে রাখি। হারিকেন জ্বালান থাকে। ওরা আগুন ভয় পায়। আগুন থাকলে কাছে আসে না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কারা?
তিনি জবাব দিলেন না।
আমি বললাম, আপনি কি ভূতপ্রেতের কথা বলছেন?
হ্যাঁ।
আমি মনে-মনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। পৃথিবী কোথায় চলে গিয়েছে–এই বৃদ্ধ তা বোধহয় জানে না! চাঁদের পিঠে মানুষের জুতোর ছাপ পড়েছে, ভাইকিং উপগ্রহ নেমেছে মঙ্গলের মরুভূমিতে, ভয়েজার ওয়ান এবং টু উড়ে গেছে বৃহস্পতির কিনারা ঘেষে, আর এই অঙ্কের শিক্ষক ভূতের ভয়ে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে রাখছে। কারণ, অশরীরীরা আগুন ভয় পায়।
আমি বললাম, আপনি কি ওদের দেখেছেন কখনো?
না।
ওদের পায়ের শব্দ পান?
তাও না।
তাহলে?
বুঝতে পারি।
বুঝতে পারেন?
জ্বি। আপনি যখন আছেন, আপনিও বুঝবেন।
ওদের কাণ্ডকারখানা দেখতে পাব, তাই বলছেন?
হুঁ, তবে ওদের না, এক জন শুধু আসে।
তাও ভালো যে এক জন আসে। আমি ভেবেছিলাম দলবল নিয়ে বোধহয় চলে আসে। নাচ গান হৈ-হল্লা করে।
আপনি আমার কথা একেবারেই বিশ্বাস করছেন না?
ঠিকই ধরেছেন, বিশ্বাস করছি না। অবশ্য এই মুহূর্তে আমার গা ছমছম করছে। কারণ, আপনার পরিবেশটা ভৌতিক।
সুধাকান্তবাবু বললেন, ওরা কিন্তু আছে।
আমি চুপ করে রইলাম। এই বৃদ্ধের সঙ্গে ভূত আছে কি নেই, তা নিয়ে তর্ক করার কোনো অর্থ হয় না! থাকলে থাকুক।
আমার কাছে যে আসে, সে একটা মেয়ে।
তাই নাকি?
জ্বি, এগার-বার বছর বয়স।
বুঝলেন কী করে তার বয়স এগার-বার? আপনাকে বলেছে?
জ্বি-না! অনুমান করে বলছি।
তার নাম কি? নাম জানেন?
জ্বি-না।
সে এসে কী করে?
সুধাকান্তবাবু বললেন, মেয়েটি যে আসছে এই কি যথেষ্ট নয়? তার কি আর কিছু করার প্রয়োজন আছে?
আমি চুপ করে গেলাম। আসলেই তো, অশরীরী এক বালিকার উপস্থিতিই তো যথেষ্ট। সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি নিজেও হয়তো দেখতে পারবেন! আমি চমকে উঠলাম। ভদ্রলোক সহজ স্বরে বললেন, আমি ছাড়াও অনেকে দেখেছে।
সুধাকান্তবাবু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন এবং তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বিকট একটা হাসি শুনলাম। উঠোন কাঁপিয়ে গাছপালা কাঁপিয়ে হো-হো করে কে যেন হেসে উঠল। সুধাকান্তবাবু পাশে না থাকলে অজ্ঞানই হয়ে যেতাম। আমি তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম, কে, কে?