অদ্ভুত একটা অবস্থা! এর চেয়ে যদি শুনতাম মেয়ে পালিয়ে গেছে, তাও ভালো ছিল। কারো ওপর রাগ ঢেলে ফেলা যেত।
আমরা বরযাত্রীরা খুবই বিব্রত বোধ করছি। স্থানীয় লোকজন এখন দেখতে পাচ্ছি। তারা বোধহয় এতক্ষণ ভেতরের বাড়িতে ছিলেন। আমরা বসার ঘরেই আছি। খিদেয় একেক জন প্রায় মরতে বসেছি। খাবার কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না। এই পরিস্থিতিতে খাবারের কথা জিজ্ঞেসও করা যায় না। একজন মামাকে কানেকানে এই ব্যাপারে বলতেই তিনি রাগী গলায় বললেন, তোমাদের কি মাথাটাথা খারাপ হয়েছে-এত বড় একটা শোকের ব্যাপার, আর তোমরা খাওয়ার চিন্তায় অস্থির! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এক রাত না খেলে হয় কী? খবরদার, আমার সামনে কেউ খাবারের কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করবে না।
আমরা চুপ করে গেলাম। বার-তের বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে এসে পানিভর্তি একটা পানদান রেখে গেল। কাঁদতে-কাঁদতে মেয়েটি চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। এখনও কাঁদছে।
মামা মেয়েটিকে বললেন, লক্ষ্মী সোনা, তোমাদের মোটেই ব্যস্ত হতে হবে না। আমাদের কিছুই লাগবে না।
রাত আটটার দিকে থাকা এবং খাওয়ার সমস্যার একটা সমাধান হল! স্থানীয় লোকজন ঠিক করলেন, প্রত্যেকেই তাঁদের বাড়িতে একজন-দুজন করে গেষ্ট নিয়ে যাবেন। বিয়ে হবে পরদিন বিকেলে।
আমাকে যিনি নিয়ে চললেন, তাঁর নাম সুধাকান্ত ভৌমিক। ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। বেঁটেখাটো মানুষ। শক্তসমর্থ চেহারা। এই বয়সেও দ্রুত হাঁটতে পারেন। ভদ্রলোক মৃদুভাষী। মাথার চুল ধবধবে সাদা। গেরুয়া রঙের একটা চাদর দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন বলেই কেমন যেন ঋষি-ঋষি লাগছে।
আমি বললাম, সুধাকান্তবাবু, আপনার বাসা কত দূর?
উনি বললেন, কাছেই।
গ্রাম এবং মফস্বলের লোকদের দূরত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তাদের কাছেই আসলে দিল্লি হনুজ দূর অস্তের মতো। আমি হাঁটছি তো হাঁটছিই।
অনুগ্রহায়ণ মাস। গ্রামে এই সময়ে ভালো শীত থাকে। আমার গায়ে পাতলা একটা পাঞ্জাবি। শীত ভালোই লাগছে।
আমি আবার বললাম, ভাই, কত দূর?
কাছেই।
আমরা একটা নদীর কাছাকাছি এসে পড়লাম! আঁতকে উঠে বললাম, নদী পার হতে হবে নাকি?
পানি নেই, জুতো খুলে হাতে নিয়ে নিন।
রাগে আমার গা জ্বলে গেল। এই লোকের সঙ্গে আসাই উচিত হয় নি। আমি জুতো খুলে পায়জামা গুটিয়ে নিলাম। হেঁটে নদী পার হওয়ার কোনো আনন্দ থাকলেও থাকতে পারে। আমি কোনো আনন্দ পেলাম না, শুধু ভয় হচ্ছে কোনো গভীর খানাখন্দে পড়ে যাই কি না। তবে নদীর পানি বেশ গরম।
সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনাকে কষ্ট দিলাম।
ভদ্রতা করে হলেও আমার বলা উচিত, না, কষ্ট কিসের তা বললাম না! নদী পার হয়ে পায়জামা নামাচ্ছি, সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি ছেলের কে হন?
ফুপাতো ভাই।
বিয়েটা না-হলে ভালো হয়। সকালে সবাইকে বুঝিয়ে বলবেন।
সে কী? মেয়েটার কারণে ছেলেটা মরল। এখন চট করে বিয়ে হওয়া ঠিক না। কিছুদিন যাওয়া উচিত।
কী বলছেন এ-সব!
ছেলেটা সকালবেল বিষ খেয়েছে। ধুতুরা বীজ। এই অঞ্চলে ধুতরা খুব হয়।
আপনি বলছেন কী ভাই?
ছেলের বাবা রাজি হলেই পারত। ছেলেটা বাঁচত। গোঁয়ারগোবিন্দ মানুষ। তার না মানেই না।
ছেলে-মেয়ের এই প্রেমের ব্যাপারটা সবাই জানে নাকি?
জানবে না কেন? মফস্বল শহরে এইসব চাপা থাকে না। আপনাদের শহরে অন্য কথা। আকছার হচ্ছে।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এ কী সমস্যা! বাকি পথ দু জন নীরবে পার হলাম!
পুরোপুরি নীরব বলাটা বোধহয় ঠিক হল না। ভদ্রলোক নিজের মনেই মাঝেমাঝে বিড়বিড় করছিলেন। মন্ত্রটন্ত্র পড়ছেন বোধহয়।
ভদ্রলোকের বাড়ি একেবারে জঙ্গলের মধ্যে। একতলা পাকা দালান। প্রশস্ত উঠেন। উঠোনের মাঝখানে তুলসী মঞ্চ। বাড়ির লাগোয়া দুটি প্রকাণ্ড কামিনী গাছ। একপাশে কুয়া আছে। হিন্দু বাড়িগুলো যেমন থাকে, ছবির মতো পরিচ্ছন্ন। উঠোনে দাঁড়াতেই মনে শান্তি-শান্তি একটা ভাব হল। আমি বললাম, এত চুপচাপ কেন? বাড়িতে লোকজন নেই?
না।
আপনি একা নাকি?
হুঁ।
বলেন কী। এক-একা এত বড় বাড়িতে থাকেন।
আগে অনেক লোকজন ছিল। কিছু মরে গেছে। কিছু চলে গেছে ইণ্ডিয়াতে। এখন আমি একাই আছি! আপনি স্নান করে ফেলুন।
স্নান-ফান লাগবে না। আপনি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করুন, তাহলেই হবে।
একটু সময় লাগবে, রান্নার জোগাড় করতে হবে।
আপনি কি এখন রান্না করবেন?
রান্না না করলে খাবেন কী? বেশিক্ষণ লাগবে না।
ভদ্রলোক গামছা, সাবান এবং একটা জলচৌকি এনে কুয়ার পাশে রাখলেন।
স্নান করে ফেলুন। সারা দিন জার্নি করে এসেছেন, স্নান করলে ভালো লাগবে। কুয়ার জল খুব ভালো। দিন, আমি জল তুলে দিচ্ছি।
আপনাকে তুলতে হবে না। আপনি বরং রান্না শুরু করুন। খিদেয় চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে।
এই লুঙ্গিটা পরুন। ধোয়া আছে। আজ সকালেই সোডা দিয়ে ধুয়েছি। আমার আবার পরিষ্কার থাকার বাতিক আছে, নোংরা সহ্য করতে পারি না।
ভদ্রলোক যে নোংরা সহ্য করতে পারেন না, তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তিনি রান্না করতে বসেছেন উঠোনে। উঠোনেই পরিষ্কার ঝকঝকে মাটির চুল। সুধাকান্তবাবু চুলার সামনে জলচৌকিতে বসেছেন। থালা, বাটি, হাঁড়ি সবই দেখি দু বার তিন বার করে ধুচ্ছেন।
সুধাকান্তবাবু।
বলুন।
আপনি বিয়ে করেন নি?
না।
চিরকুমার?
ঐ আর কি।
আপনি করেন কী?
শিক্ষকতা করি। হাই স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। মনোহরদি হাই স্কুল।