আমাদের পরম সৌভাগ্য যে রুগিণীর জ্ঞান নেই। জ্ঞান থাকলে এই ভয়াবহ দৃশ্য তাকে দেখতে হতো।
ডাক্তার সেন বললেন–কিল ইট। এক্ষুনি এটাকে মেরে ফেলা দরকার।
জন্তটি কি মানুষের কথা বুঝতে পারে? ডাক্তার সেনের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র ও তীক্ষ্ণ শব্দ বের হয়ে এল। অত্যন্ত হাই ফ্রিকোয়েন্সি সাউন্ড যা মানুষের স্নায়ুকে প্রচণ্ড ঝাঁকিয়ে দেয়।
ডাক্তার সেন বললেন— অপেক্ষা করছেন কেন? কিল ইট।
জন্তুটি এগুতে শুরু করেছে। শুড়গুলি বড় হচ্ছে, ছোট হচ্ছে আর সে এগুচ্ছে তার মার দিকে। আমরা দেখছি সে মেঝে বেয়ে তার মার খাটের দিকে যাচ্ছে। খাট বেয়ে উপরে উঠছে। আশ্রয় খুঁজছে মার কাছে। যেন সে জেনে গেছে এই অকরুণ পৃথিবীতে একজনই শুধু তাকে পরিত্যাগ করবে না।
ডাক্তার সেন বললেন, আপনারা অপেক্ষা করছেন কেন? কিল ইট।
আবার আগের মতো শব্দ হলো। জম্ভটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডাক্তার সেনের দিকে। তার চোখ দুটি মানুষের চোখ। সেই চোখের ভাষা আমরা জানি। সেই চোখ করুণা এবং দয়া ভিক্ষা করছে। কিন্তু করুণা সে আমাদের কাছ থেকে পাবে না। আমরা মানুষ, আমরা আমাদের মাঝে তাকে গ্রহণ করব না। এই ভয়ংকর অসুন্দর ও কুৎসিতকে আমরা আশ্রয় দেব না। সে পশু হয়ে এলে ভিন্ন কথা ছিল। সে পশু হয়ে আসেনি। মানুষের সিঁড়ি বেয়ে এসেছে।
ডাক্তার সেন বললেন, এই জম্ভটিকে যে মেরে ফেলতে হবে এ বিষয়ে কি আপনাদের কারো মনে কোনো দ্বিধা আছে?
আমরা সবাই বললাম না, আমাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই।
ডাক্তার সেন বললেন, আপনারা কি মনে করেন, এই জম্ভটি হত্যার আগে তার আত্মীয়স্বজনদের মত নেয়া উচিত?
আমরা বললাম না, আমরা তাও মনে করি না।
যে লোহার দণ্ডটি থেকে স্যালাইন ওয়াটারের ব্যাগ ঝুলছিল আমি তা খুলে হাতে নিলাম। জন্তুটি এখন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কী সুন্দর বড় বড় শান্ত চোখ! কী আছে ঐ চোখে? ঘৃণা, দুঃখ, হতাশা? জটা খাটের পা বেয়ে অর্ধেক উঠে গিয়েছিল। সেখানেই সে থেমে গেল। বোধহয় বুঝতে পেরেছে আর উঠে লাভ নেই।
প্রথম আঘাতটি করলাম আমি।
সে অবিকল মানুষের মতো গলায় ডাকল— মা, মা।
তার মা সাড়া দিল না।
আমার হাত থেকে লোহার রডটি পড়ে গিয়েছিল। ডাক্তার সেন তা কুড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। হত্যাকাণ্ডে বেশি সময় লাগল না।
ডাক্তার হাসনা বানুকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। এই ঘটনার কী কোনো ব্যাখ্যা আপনি দাঁড় করাতে পারেন?
ডাক্তার হাসনা ক্লান্ত গলায় বলেছিলেন আমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই, তবে এই ঘটনার প্রায় সাত বছর পর আমেরিকান জার্নাল অব মেডিক্যাল সোসাইটিতে এরকম একটি শিশুর জন্মবৃত্তান্তের কথা পাই। শিশুটির জন্ম হয়েছিল বলিভিয়ার এক গ্রামে। শিশুটির বর্ণনার সঙ্গে আমাদের জন্তুটির বর্ণনা হুবহু মিলে যায়। ঐ শিশুটিকেও জন্মের কুড়ি মিনিটের মাথায় হত্যা করা হয় এবং রিপোর্ট অনুসারে সেও মৃত্যুর আগে ব্যাকুল হয়ে বলিভিয়ান ভাষায় মাকে কয়েকবার ডাকে।
আপনার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই?
না। তবে আমার একটা হাইপোথিসিস আছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রকৃতি ইভোলিউশন প্রক্রিয়ায় হয়তো নতুন কোনো প্রাণ সৃষ্টির কথা ভাবছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। আমরা প্রাণপণে সেই প্রক্রিয়াকে বাধা দিচ্ছি।
আপনার ধারণা এরকম ঘটনা আরো ঘটবে?
হ্যাঁ। প্রকৃতি সহজে হাল ছাড়ে না। সে চেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং সে লক্ষ রাখবে যাতে ভবিষ্যতে আমরা বাধা দিতে না পারি। ঐ যে মা আগে স্বপ্ন দেখলেন তার একটিই ব্যাখ্যা প্রকৃতি শিশুটি রক্ষার চেষ্টা করছে। এ ধরনের প্রোটেকশান দেবার চেষ্টা করছে। এখন সে পারছে না। তবে ভবিষ্যতে সে নিশ্চয়ই আরো কোনো ভালো প্রোটেকশানের ব্যবস্থা করবে।
আপনি কি আপনার হাইপোথিসিস বিশ্বাস করেন? ডাক্তার হাসনা বানু জবাব দিলেন না। তাঁর কাছে এই প্রশ্নের জবাব নেই। জবাব থাকার কথাও নয়। কিছু কিছু সময় আসে যখন আমরা বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের সীমারেখায় বাস করি। তখন একই সঙ্গে আমরা দেখতে পাই এবং দেখতে পাই না। বুঝতে পারি এবং বুঝতে পারি না। অনুভব করি এবং অনুভব করি না। সে বড় রহস্যময় সময়।
০১. সুধাকান্তবাবু গল্প শুরু করলেন
অতিপ্রাকৃত গল্পে গল্পের চেয়ে ভূমিকা বড় হয়ে থাকে।
গাছ যত-না বড়, তার ডালপালা তার চেয়েও বড়। এই গল্পেও তাই হবে। একটা দীর্ঘ ভূমিকা দিয়ে শুরু করব। পাঠকদের অনুরোধ করছি তাঁরা যেন ভূমিকাটা পড়েন। এর প্রয়োজন আছে।
আমার মামাতো ভাইয়ের বিয়ে।
বাবা-মার একমাত্র ছেলে, দেখতে রাজপুত্র না হলেও বেশ সুপুরুষ। এম এ পাস করেছে। বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করা এবং গ্রুপ থিয়েটার করা–এই দুইয়ে তার কর্মকাণ্ড সীমিত।
বাবা-মার একমাত্র ছেলে হলে যা হয়-বিয়ের জন্যে অসংখ্য মেয়ে দেখা হতে লাগল। কাউকেই পছন্দ হয় না। কেউ বেশি লম্বা, কেউ বেশি বেঁটে, কেউ বেশি ফর্সা, কেউ বেশি কথা বলে, আবার কেউ-কেউ দেখা গেল। কম কথা বলে। নানান ফ্যাকড়া।
শেষ পর্যন্ত যাকে পছন্দ হল, সে-মেয়ে ঢাকা ইডেন কলেজে বিএ পড়ে— ইতিহাসে অনার্স মেয়ের বাবা নেই। মার অন্য কোথায় বিয়ে হয়েছে। মেয়ে তার বড়চাচার বাড়িতে মানুষ। তিনিই তাকে খরচপত্র দিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন।
আমার মামা এবং মামী দু জনের কেউই এই বিয়ে সহজভাবে নিতে পারলেন না। যে-মেয়ের বাবা নেই, মা আবার বিয়ে করেছে–পাত্রী হিসেবে সে তেমন কিছু না। তা ছাড়া সে খুব সুন্দরীও না। মোটামুটি ধরনের চেহারা। আমার মামাতো ভাই তবু কেন জানি একবারমাত্র এই মেয়েকে দেখেই বলে দিয়েছে—এই মেয়ে ছাড়া আর কাউকে সে বিয়ে করবে না। মেয়ের বাবা নেই তো কী হয়েছে? সবার বাবা চিরকাল থাকে নাকি? মেয়ের মার বিয়ে হয়েছে, তাতে অসুবিধাটা কী? অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন, তাঁর তো বিয়ে করাই উচিত; এমন তো না যে, দেশে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ।